মালিকানাবিহীন রাখাইনের আকাশ: বাংলাদেশের সামনে কৌশলগত সুযোগ

মালিকানাবিহীন রাখাইনের আকাশ: বাংলাদেশের সামনে কৌশলগত সুযোগ
ছবি: সংগৃহীত

২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে গেছে। রাখাইন রাজ্যের আকাশে বিমান অভিযান চালানোর ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এটা শুধু সামরিক পরাজয় নয় বরং বিমান শক্তির ক্ষেত্রে জান্তা বাহিনীর কৌশলগত পতনের নমুনা। রাখাইনের আকাশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার এখন কেউ নেই। এই পরিস্থিতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য একই সঙ্গে সুযোগ এবং ঝুঁকি তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য। তারা চাইলে এখন নিজ সীমানায় বসে কোন প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা ছাড়াই রাখাইনের আকাশে স্বাধীনভাবে ড্রোন পরিচালনা করতে পারে।

এই রাজ্যে আগেও মিয়ানমার বাহিনীর বিমান শক্তি ছিল সীমিত আকারে। অ্যান এবং সিত্তুইয়ের কাছে কিছু সেনাঘাঁটিতে এমআই-১৭ ও এমআই-৩৫পি এর মতো হেলিকপ্টার মোতায়েন ছিল। এগুলো মূলত সেনা পরিবহন, আহত অপসারণ অথবা বিদ্রোহদমন অভিযানে ক্লোজ-এয়ার সাপোর্টের কাজে ব্যবহার করা হতো। সীমিত আকারে হামলা চালানোর জন্য সামরিক বাহিনী মাঝে মাঝে কে-৮ডব্লিউ এর মতো হালকা বিমান ব্যবহার করেছে। বিদ্রোহীদের পাল্টা হামলার আশঙ্কা নেই এমন পরিবেশে এসব বিমান ব্যবহার করা হতো।

মৌলিক গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য পরিবহন বিমান কনফিগার করে পরিচালনা করা হত। তবে, এই মিশনগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ও পাহাড়ি এলাকা এবং দক্ষিণ উপকূলে সীমাবদ্ধ। স্থল-ভিত্তিক রাডার ইউনিটগুলো মোতায়েন করা হয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায়। এগুলোর সনাক্তকরণ ক্ষমতাও ছিল সীমিত। এসব সিস্টেম এতটাই দুর্বল যে সেগুলোর সেন্সর ও শ্যুটারের মধ্যে কোনও অর্থপূর্ণ সমন্বয় ছিল না। কৌশলগত স্তরে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলতে ছিল কাঁধে বহনযোগ্য এফএন-৬ ও কিউডব্লিউ-২ এর মতো সিস্টেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলো সামরিক ফাঁড়িতে রাখা হতো, তবে কোন সুসংহত বিমান প্রতিরক্ষা কৌশলের উপাদান হিসাবে নয় বরং প্রতিরোধক হিসাবে।

কিন্তু আরাকান আর্মির (এএ) উত্থানে বিগত তিন বছরে কৌশলগত পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি গেরিলা থেকে প্রায় প্রচলিত সামরিক বাহিনীতে রূপ নিয়েছে। তারা রাখাইন জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং সামরিক স্থাপনা দখল করে নিয়েছে। সিত্তুই, কিয়াউকফিউ এবং ম্রাউক-ইউ শহর পতনের ফলে মিয়ানমারের বিমান শক্তি প্রয়োগের অবশিষ্ট ক্ষেত্রগুলোও বিনষ্ট হয়েছে। এখানকার রাডার সাইটগুলো ধ্বংস অথবা বেদখল  কিম্বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে এই অঞ্চলের সামরিক বিমানঘাঁটিগুলো হয় দখল বা পরিত্যক্ত অথবা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন আর রাখাইনে বিমান অভিযান পরিচালনা করে না। এখানকার বিমানগুলো হয় প্রত্যাহার অথবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে গোয়েন্দা বিমান বা হেলিকপ্টার মিশনের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। অ্যান এয়ারবেস এখন নামমাত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীরা এটি ঘিরে রেখেছে। ঘাঁটিটি কোন লজিস্টিক সহায়তাও পাচ্ছে না। এখান থেকে রাখাইনের কোন অভিযানে বিমান সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্তে এখন কোনও রাডার কভারেজ নেই। সেখানে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বা বিমান বিধ্বংসী ইউনিটও মোতায়েন নেই।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে বায়রাক্টর টিবি২ কমব্যাট ড্রোন। এগুলো রিয়েল-টাইম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি, টার্গেট অনুসন্ধান এবং নিখুঁত হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে। এছাড়া, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অস্ত্রবহনে সক্ষম লিওনার্দো সেলেক্স ফ্যালকো ড্রোন ব্যবহার করে। এগুলো পাল্টা আক্রমণের ঝুঁকি ছাড়াই রাখাইনে অভিযান চালাতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে রাখাইনের উপর নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে বাংলাদেশ। যার মধ্যে থাকতে পারে শত্রুর গতিবিধি ট্র্যাক করা, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা পর্যবেক্ষণ এবং এলাকা ও অবকাঠামোর মানচিত্র তৈরি। প্রয়োজনে চিহ্নিত লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে অভিযানও চালাতে পারে এসব ড্রোন। বর্তমানে সেখানে এ ধরনের অভিযান প্রতিরোধের কেউ নেই।

যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের পরও আরাকান আর্মির মধ্যে নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও আগ্রহ দেখা যায় না। তাদের কাছে রাডার, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম বা ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপনাস্ত্রও নেই। স্থল অভিযান এবং আঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দিকেই তাদের  মনযোগ। ফলে রাখাইনের আকাশ এখন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। এমনকি খুব নিচু দিয়ে ড্রোন উড়ে গেলেও সেগুলো প্রতিরোধ করার মতো কেউ ওই অঞ্চলে নেই।

কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজস্ব আকাশসীমার উপর সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে অক্ষমতা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার একটি নাটকীয় ব্যর্থতা। আকাশসীমা লঙ্ঘন রোধ করার মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তাদের নেই। মিয়ানমার তার এয়ার সারভেইল্যান্স নেটওয়ার্ক এবং বিমান শক্তি পুনর্গঠন করতে না পারলে রাখাইনের আকাশসীমার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব। তার আগ পর্যন্ত উন্নত ব্যবস্থার অধিকারী বহিরাগত যেকোন পক্ষের জন্য এই অঞ্চলটি উন্মুক্ত করিডোর হিসাবে থাকবে। আপাতত রাখাইনের আকাশের কোন মালিক নেই। যে কেউ সেখানে খুশি মনে বিচরণ করতে পারে।

বিডিমিলিটারি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ