পক্ষকালেরও বেশি সময় পরে অবশেষে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে যুদ্ধ বিমান হারানোর কথা ভারত স্বীকার করেছে। তবে এখনো সংখ্যাটি প্রকাশ করেনি। পাকিস্তানের দাবি ৬টি, যার মধ্যে ৩টি ফ্রান্সের তৈরি রাফাল। এই রাফাল নিয়ে নয়াদিল্লির গর্বের শেষ ছিল না, নরেন্দ্র মোদির সরকার যেন আকাশে উড়ছিল। তাকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে চারদিনের যুদ্ধ।
তবে, এই স্বীকারোক্তি সরকারের তরফ থেকে আসেনি। এসেছে প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান (চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ) জেনারেল অনিল চৌহানের কাছ থেকে। সিঙ্গাপুরে সিকিউরিটি ফোরাম ‘শাংগ্রিলা ডায়ালগে’র সাইডলাইনে শনিবার (৩১ মে) বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা স্বীকার করেন।
অবশ্য, জেনারেল অনিল ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমানের সংখ্যা সম্পর্কে মুখ খোলেননি। তিনি বলেন, কয়টি বিমান ধ্বংস হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো – কেন এই দুর্ঘটনা ঘটলো এবং এখন আমরা কী করবো?
যুদ্ধ বিমান হারিয়ে দেশে-বিদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় শুরু থেকেই নরেন্দ্র মোদি সরকার ‘মুখে কুলুপ এঁটে থাকা’র নীতি গ্রহণ করে। গত সপ্তাহে এক পডকাস্ট সাক্ষাতকারে প্রথম ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সিনিয়র নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী যুদ্ধবিমান হারানোর কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, চীনা যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে পাকিস্তান আমাদের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেছে। তাদের পারফরম্যান্স প্রশংসনীয়, যেখানে আমাদের ফরাসি রাফাল বিমানগুলো ছিল হতাশাজনক।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রমাণহীন অভিযোগ এনে ৭ মে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে ভারত হামলা চালায়। পাল্টা হামলায় পাকিস্তান ভারতীয় বিমানগুলো ঘায়েল করে। এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়া যাবে বলে ভারত মনে করেছিল। অথচ শেষ পর্যন্ত উল্টো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে ভারতকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে হয়।
এই পরিস্থিতিতে দেশেতো বটেই আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও ভারতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না দেশটি। মরিয়া হয়ে তারা দেশে দেশে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ মিশন পাঠাচ্ছে।
রোববার (১ জুন) ওয়াশিংটন পোস্ট লিখে, পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধকে ঘিরে হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে ভারত বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশের রাজধানীতে এক ঝাঁক অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও অবসরপ্রাপ্ত ঝাঁনু কূটনীতিককে পাঠিছে। তারা মিত্র সরকারগুলোকে পাকিস্তানে হামলার যৌক্তিকতা বুঝানোর চেষ্টা করবে।
এমনই এক মিশনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিরোধী কংগ্রেসের নেতা ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি শশী থারুর। তিনি ট্রাম্প প্রশাসনকে বুঝানো জন্য এখন ওয়াশিংটনে রয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মির বিরোধ নিরসনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়ায় নয়াদিল্লি অস্বস্তিতে রয়েছে।
নয়াদিল্লির জন্য আরেকটি সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ভারত ও পাকিস্তানকে আলাদা চোখে দেখতো। কূটনীতির পরিভাষায় যাকে বলে ডি-হাইফেনেটেড। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন দুই দেশকে একই পাল্লায় মাপছে বা হাইফেনেট করছে। ভারত এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। চারদিনের যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সুক্ষ্ম ভারসাম্য এমনভাবে নষ্ট করেছে যে পিঠে হাত বুলিয়ে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
এ ব্যাপারে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের প্রফেসর সুশান্ত সিং ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে যে মোদির কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিনিধিদলগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়। এতে বিজেপি দেখাতে চায় যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা একাট্টা। অবশ্য এখানেও রাজনীতি আছে বলে সিং মনে করেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য লোকসভার অধিবেশন ডাকতে বলেও মোদি তাতে কান দেননি এবং প্রতিনিধিদলের সদস্য নির্বাচন নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনাও করেননি।
সমালোচকরা বলছেন, ভারতীয় প্রতিনিধিরা যখন সিউল থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত বহু রাজধানী চষে বেড়াচ্ছেন তখনও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদি সরকারের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি।
যেসব প্রশ্নের উত্তর নেই
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২২ এপ্রিল পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করে ভারতের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেও ৭ মে ভারতের প্রথম দফা হামলার পর অবিলম্বে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানান। এর পরপরই ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন যে তার দেশ ‘একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য’ উভয় পক্ষের সাথে কাজ করছে। এই বক্তব্য নয়াদিল্লিতে অস্বস্তি তৈরি করে। কারণ এতে উদীয়মান বিশ্ব শক্তি হিসাবে ভারতের অবস্থানকে আমলে নেয়া হয়নি। মজার বিষয় ছিল পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে ওয়াশিংটন থেকে।
ভারত কাশ্মিরে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ি করে কিন্তু এর কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। বিপুল সংখ্যক সেনা উপস্থিতির মধ্যে এই হামলা নিরপত্তা নিয়ে ভারতের এতদিনের দাবিকে দুর্বল করে দিয়েছে। প্রায় দেড় মাস হতো চললো এখনো অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। নি:সন্দেহে এটা গুরুতর গোয়েন্দা ব্যর্থতা। কিন্তু ভারতে কেউ এই প্রশ্নটি করতে পারছে না কারণ এতে প্রশ্নকারী হেনস্তার শিকার হতে পারেন, দেশবিরোধী আখ্যা পেতে পারেন।
নয়াদিল্লির একজন পশ্চিমা কূটনীতিক ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, কাশ্মির হামলা তদন্তে ভারতের স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এতে পাকিস্তান জড়িত এমন কোন তথ্য তারা প্রকাশ করছে না। এমনকি যুদ্ধবিমান হারানোর তথ্যও চেপে রেখেছে।
অনেক এজেন্ডা
হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে ভারতের সাতটি প্রতিনিধিদল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা কাতারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী; গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেছেন। প্রতিনিধিরা প্রবাসী ভারতীয়দের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন।
বৈঠকগুলোতে পারমাণবিক উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার বিষয়ে কথা বলে জানা গেছে।
ভারতীয় প্রতিনিধিরা সাংস্কৃতিক কূটনীতির পথেও হাটছেন। যেমন, কুয়েতে তারা গ্র্যান্ড মসজিদ পরিদর্শন করেন। তারা নিউ ইয়র্কে ৯/১১ স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন। সিউলে গিয়ে প্রতিনিধি দলের নেতা একজন কোরিয়ান ইনফ্লুয়েন্সারের সঙ্গে ছবি তোলেন। সাবলীল হিন্দি বলতে পারায় ওই ইনফ্লুয়েন্সর ভারতে জনপ্রিয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রতিনিধিদল সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটি এবং কংগ্রেসের পরাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করবে বলে জানা গেছে।
এদিকে, পাকিস্তানও বসে নেই। ভারতের এই কূটনৈতিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে তারাও নিজস্ব প্রচারণা শুরু করছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছেন যে তিনি শান্তির জন্য পাকিস্তানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে একটি দলের নেতৃত্ব দেবেন।
অনেকে মনে করেন ওয়াশিংটনে ভারতীয় প্রতিনিধিদল যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারেন।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক মিলান বৈষ্ণব ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ভারত নিজেকে একটি উদীয়মান বৃহৎ শক্তি বলে মনে করে। সে এত দিন মনে করেছে, যেকোন চ্যালেঞ্জ সে নিজেই সমাধান করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কাশ্মির নিয়ে সংঘাত বন্ধে ট্রাম্পের বক্তব্যে নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা এখন বিচলিত বোধ করেছেন।