ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক: ভালো বেড়া দিলেই সুপ্রতিবেশী হওয়া যায় না

ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক: ভালো বেড়া দিলেই সুপ্রতিবেশী হওয়া যায় না
ভারতের মনিপুর রাজ্যের মোরেহ এলাকার মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে কাপড় শুকাতে দিয়েছেন ভারতীয় মহিলারা। ছবি: সংগৃহীত

তিয়াউ নদী মিয়ানমারের চিন রাজ্য থেকে ভারতের মিজোরামকে আলাদা করেছে। নদীর শুকনো চরগুলো দুই প্রতিবেশি দেশের নাগরিকদের জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র। মিজোরামে এ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ, তাই ভারতের নাগরিকরা এ্যালকোহল কিনতে চরের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে মিয়ানমারে চলে যান। আরও উত্তরে, নাগাল্যান্ডের লংওয়া গ্রাম। সীমান্ত রেখা এই গ্রামের সরদারের বাড়িটিকে আক্ষরিক অর্থেই দু’ভাগ করে ফেলেছে।

হাজার মাইল দীর্ঘ ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তার অযুহাতে ভারতের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগে শুধু এই সাপ্তাহিক বিনোদন কেন্দ্রগুলোই নয় – সেইসাথে বাণিজ্য, অভিবাসন, ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক সম্পর্ক – সবই বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোন সমঝোতা ছাড়াই ভারত সরকার তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। নয়াদিল্লির যুক্তি হলো এই বেড়া চোরাচালান, বিদ্রোহ এবং অবৈধ অভিবাসন রোধ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো থেকে শুরু করে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সীমান্তগুলোতে বেড়া নির্মাণ প্রবণতার প্রতিফলন ঘটছে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে।

এশিয়ায় সীমান্ত বেড়ার দৈর্ঘ্য বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। শীতল যুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে বিশ্বব্যাপী সীমান্ত দেয়াল ও বেড়ার সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে যা ছিল মাত্র এক ডজন, তা এখন দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৭৪টিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ২০১৪ সালে সীমান্ত বেড়ার মোট দৈর্ঘ্য ১৯৫ মাইল, যা বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ১,২০০ মাইলেরও বেশি। বিশ্বের প্রতি ১০ জন মানুষের ছয়জন এখন এমন একটি দেশে বাস করে যারা তাদের সীমান্তে দেয়াল তৈরি করেছে।

৯/১১ পরবর্তী সময়ে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ এবং সীমান্ত সুরক্ষার আকাঙক্ষা – সবকিছু মিলিয়ে এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নতুন নজরদারি শিল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। যার বদৌলতে নজরদারি প্রযুক্তি, নির্মাণ চুক্তি এবং বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পকেটে কোটি কোটি ডলার ঢুকছে। ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী সীমান্ত নিরাপত্তার পেছনে ব্যয় হবে ৪৯.৫৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৯ সালের মধ্যে এটি ৬৩.৬১ বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বেড়া দেয়া হচ্ছে তা কি হাসিল হচ্ছে?

বিশ্বজুড়ে চোরাচালান এবং বেড়া নির্মাণের উপর গবেষণা, সেইসাথে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী চোরাকারবারি, নিরাপত্তা বাহিনী এবং মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, সীমান্ত বেড়া সম্ভবত অপরাধমূলক তৎপরতাকে ভিন্ন রূপ দেয়, সীমান্তে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

ভারত বলছে যে এটি উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, অবৈধ কার্যকলাপ রোধ এবং অবকাঠামো উন্নত করার একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এতে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অস্ত্র, মাদক এবং নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান কমবে। মিয়ানমারে সংঘাতের ফলে সহিংসতা থেকে পালিয়ে মানুষ মিজোরামে ঢুকছে। এর ফলে মিজোরাম-মিয়ানমার সীমান্তে অর্থনীতি সত্যিই সমৃদ্ধ হচ্ছে। গত দুই বছরে শুধুমাত্র এই একটি ক্রসিংয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ২৭৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মাদকদ্রব্য – প্রধানত হেরোইন ও মেথামফেটামিন – জব্দ করেছে। তবে এটা মোট চোরাচালানের ৫% শতাংশ বলে নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি। প্রতিবেশী মণিপুর রাজ্যে জাতিগত সংঘাত এবং মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় অস্ত্র পাচারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এটা হয়তো ঠিক যে অপরাধ ঠেকাতে অনেক ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মী সুদীর্ঘ পাহাড়ি, ছিদ্রযুক্ত সীমান্তে টহল দিতে দিতে ক্লান্ত। তারা বেড়াকে একটি সুন্দর সমাধান হিসেবে দেখেন। তবে অনেকেই স্বীকার করেন যে কেবল ছিদ্রযুক্ত সীমান্ত বন্ধ করলেই চোরাচালান বন্ধ হবে – বিষয়টি এমন নয় বরং এর জন্য জন্য দায়ি রাজ্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতি।

সীমান্তে চোরাকারবারী ও রাজ্যের বিভিন্ন পদে থাকা লোকজনের মধ্যে একটি জটিল এবং সহজাত সম্পর্ক রয়েছে। সীমান্তে বেড়া দিয়ে এই দুর্নীতি দূর করতে পারার সম্ভাবনা কম।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে চোরাচালান সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গেছে, এটি বিভিন্ন ধরণের আনুষ্ঠানিকতা এবং আইনি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রায়শই রাষ্ট্রীয় পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে । যেমন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কিছু চোরাচালান রুটকে নীরবে অনুমোদন দেন। তারা নিজেদের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্থির অঞ্চলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চোরাকারবারীদের সাথে একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করেন।  একইভাবে, উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশ এ ধরনের কিছু কার্যকলাপ ইচ্ছা করেই মেনে নেয়। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে বেড়ার মতো সীমান্ত দুর্গ চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলোকে ভাঙ্গতে করতে পারে না বরং এগুলোকে নতুন রূপে সংগঠিত হতে সহায়তা করে। তখন বড় চোরকারবারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আর ছোটখাট চোরাকারবারীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে।

হয়তো সে কারণেই ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত চোরাকারবারীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাকে বেড়া নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। সীমান্ত এলাকায় অভিযান তদারককারী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সদস্যের বক্তব্য হলো, “কোটি কোটি টাকা আয়কারী বড় বড়  চোরাকারবারীদের জন্য বেড়ার মতো কোনও প্রতিরোধক কাজ করবে না।”

তবে, ছোট ছোট অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে আলাদা কথা। তাদের একজন জোর দিয়ে বলেন যে ছোট ব্যবসায়ীর জন্য, কোনও বেড়া না থাকাই সর্বদা ভাল।

আরেক ব্যবসায়ী বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন – স্থানীয়রা সবসময় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের ব্যবসা করবে।

সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে গভীর সাংস্কৃতিক এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান কীভাবে বেড়ার কারণে সামাজিক বন্ধন ভেঙে যাবে, তারপর, অর্থনৈতিকও। ব্যবসায়ীরা চান সরকার যেন বাস্তবতা বিবেচনা করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে সীমান্ত অবকাঠামোর প্রসার ঘটছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশ এবং সীমান্তে বেড়ার মতো অবকাঠামো চোরাচালানের খরচ বাড়ায়। বাধা অতিক্রম করে পণ্য পরিবহনের প্রযুক্তিগত খরচ অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সম্পর্কের আর্থিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে এটা হয়।

ঐতিহাসিকভাবে, প্রাচীনকাল থেকেই ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে পণ্য, মানুষ এবং ধর্মীয় চিন্তাধারার বিনিময় ঘটছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র লক্ষ্য সম্পর্কগুলোকে শক্তিশালীকরণ, কৌশলগত অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার করা। অথচ সীমান্ত বেড়া নানাভাবে সম্প্রদায়গুলোকে বিভক্ত এবং আঞ্চলিক সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পরস্পরবিরোধী এই নীতি আসলেই বিভ্রান্তিকর।

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ