মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক নিরাপত্তার হিসাব বদলে দিতে পারে সৌদি–পাকিস্তান চুক্তি

মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক নিরাপত্তার হিসাব বদলে দিতে পারে সৌদি–পাকিস্তান চুক্তি

উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো ইসরায়েল থেকে ক্রমে বেশি হুমকি অনুভব করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে গত বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ (এসএমডিএ) সই করেছে সৌদি আরব ও পাকিস্তান। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রিয়াদের অর্থশক্তি ও ইসলামাবাদের বিশাল পারমাণবিক ক্ষমতার দারুণ মেলবন্ধন হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামাবাদকে বিভিন্নভাবে অর্থসহায়তা দেবে রিয়াদ। বিনিময়ে প্রয়োজনীয় পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে রিয়াদের পাশে দাঁড়াবে ইসলামাবাদ।

চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কিছু এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে পাকিস্তানের ঘোষিত পারমাণবিক নীতি হলো, শুধু চির বৈরী প্রতিপক্ষ ভারতকে লক্ষ্য করেই দীর্ঘমেয়াদে তাদের (পারমাণবিক) অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু রিয়াদ ইঙ্গিত দিচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির করার মধ্য দিয়ে তারা কার্যত পারমাণবিক সুরক্ষা বলয়ের নিচে চলে এসেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ইসরায়েল সৌদি আরব-পাকিস্তানের চুক্তিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, এ চুক্তির ‘আওতায়’ পারমাণবিক অস্ত্র নেই। অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র–সম্পর্কিত কোনো ধারা নেই, শুধু প্রচলিত সামরিক সহযোগিতার বিষয় আছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশকেও ভবিষ্যতে এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।

খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেন, ‘কোনো আগ্রাসনের জন্য আমাদের এ চুক্তি ব্যবহার করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু যদি কোনো পক্ষ (সৌদি আরব বা পাকিস্তান) হুমকির মুখে পড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এটা কার্যকর হবে।’ ইসলামাবাদ যা–ই বলুক, চুক্তির আওতায় পারমাণবিক অস্ত্র থাকছে কি না, তা ভিন্নভাবে দেখছে রিয়াদ।

উপসাগরীয় আরব দেশগুলো বলছে, কাতারে ৯ সেপ্টেম্বর হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল কার্যত যেকোনো আরব দেশে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দিয়ে রেখেছে।

এদিকে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত নিজেদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটি করেনি। তবে ধারণা করা হয়, দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে সৌদি আরব ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে তারাও করবে।

সৌদি আরবের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে রয়টার্স জানতে চেয়েছিল, পাকিস্তান কি এখন সৌদি আরবকে পারমাণবিক সুরক্ষা দেবে?। উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি। সব ধরনের সামরিক উপায় এর অন্তর্ভুক্ত।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে যে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, এ চুক্তির মধ্যে সেটির ওপর নির্ভরশীলতা কমারও প্রতিফলন রয়েছে।

লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) মধ্যপ্রাচ্য নীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো হাসান আল হাসান বলেন, ‘সৌদি আরবের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, পারমাণবিক শক্তিধর ইসরায়েলের তুলনায় কৌশলগত ও প্রচলিত সক্ষমতায় পিছিয়ে থাকা দেশটি এ চুক্তির মধ্য দিয়ে শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে।’

সৌদি আরব এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এ চুক্তির লক্ষ্য, উভয় দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিভিন্ন দিক উন্নত করা এবং (আক্রমণ) প্রতিহত করার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।’ কিন্তু এ চুক্তিতে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হলেও সৌদি আরবের গণমাধ্যম বিভাগ তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করেনি।

চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরাও মন্তব্য করেননি। চুক্তিটি পাকিস্তানের প্রতিবেশী ভারত ও ইরানেও উদ্বেগ তৈরি করে থাকতে পারে।

পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষমতা

পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল; কিন্তু সারা বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যার রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র।

পাশাপাশি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও বেশ বড়, সদস্য ছয় লাখের বেশি। মানে দেশটি বৈরী প্রতিবেশী ভারতকে মোকাবিলায় প্রস্তুত। পারমাণবিক শক্তিধর এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এরই মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধ ও অনেকগুলো ছোট ছোট সংঘাত হয়েছে। গত মে মাসে তাদের মধ্যে চার দিনের পাল্টাপাল্টি বিমান ও ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। এটি গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত।

রিয়াদ-ইসলামবাদ চুক্তির যতটুকু এ পর্যন্ত জানা গেছে, তাতে পারমাণবিক অস্ত্র বা অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে সরাসরি কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। পাকিস্তান বলেছে, ‘চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের ওপর হামলা হলে, তা উভয় দেশের ওপর আগ্রাসন বলে গণ্য হবে।’

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বিষয়ে তিনি গভীর আগ্রহী।

ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে। পাকিস্তান এমন ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে, যা ভারতের একেবারে গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম। অন্যদিকে খাতা-কলমের হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের ইসরায়েলে আঘাত করার সক্ষমতাও রয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনা বিভাগের (পারমাণবিক অস্ত্র তত্ত্বাবধান করে) সাবেক কর্মকর্তা আদিল সুলতান বলেন, ‘আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ভারতের যেকোনো স্থানে আঘাত করতে সক্ষম।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েল কখনো স্বস্তিবোধ করেনি। কিন্তু আমাদের (পারমাণবিক) সক্ষমতা খুব সীমিত এবং ভারতকে লক্ষ্য করেই এসব তৈরি করা হয়েছে।’

গত বছর হোয়াইট হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটি দেশটিকে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের নিশানায় আঘাত করার সুযোগ করে দেবে।’ কিন্তু ইসলামাবাদ এ দাবি অস্বীকার করেছে।

ওই চুক্তির নিয়ে সৌদি আরবভিত্তিক গালফ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ সাগের বলেন, পারমাণবিক কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানার মতো সময় এখনো হয়নি। তবে তিনি বলেন, ‘শুধু মার্কিন নিরাপত্তার ওপর ভরসা করা উচিত নয়। কারণ, এটারও সীমাবদ্ধতা আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা করেছিলেন, আব্রাহাম চুক্তির আওতায় চলতি মেয়াদে তিনি আরও কিছু আরব দেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন; কিন্তু মনে হয় না তা সম্ভব হবে। রিয়াদ এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে, গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের প্রবেশ

সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের অল্পসংখ্যক সেনা অবস্থান করছেন; কিন্তু নতুন চুক্তি আরও বড় ধরনের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলেন, ‘পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে; কিন্তু তারা এমন এক অঞ্চলে প্রবেশ করছে, যা অত্যন্ত অস্থির ও সংঘাতপ্রবণ।’

পাকিস্তানের সিনেটের প্রতিরক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মুশাহিদ হুসেইন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি প্যান-ইসলামিক (মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকেন্দ্রিক) ছিল। পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা রয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে আমরা অর্থনীতি শক্তিশালী করতে পারছি। উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে এখন পাকিস্তানই নতুন কৌশলগত বিকল্প।’

প্রতিবেশী ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের সাত গুণের বেশি। এ পরিস্থিতিতে সৌদি আরব থেকে অর্থ পেলে দেশটি সামান্য হলেও ভারসাম্য আনতে পারে। রিয়াদ কয়েক দশক ধরেই ইসলামাবাদকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ৩০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে তারা।

ভারত বৃহস্পতিবার বলেছে, তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর এ ঘটনার (রিয়াদ-ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি) প্রভাব কেমন, তারা তা পরীক্ষা করে দেখবে।

রয়টার্স