ফিরে দেখা ২০২৪: মিয়ানমার জান্তার বেপরোয়া কূটনীতি

ফিরে দেখা ২০২৪: মিয়ানমার জান্তার বেপরোয়া কূটনীতি

বিশ্বের ১২৬টি দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কূটনৈতিক মিশন আছে ৩৭টি দেশে। তাই বলে দেশটির শীর্ষ কর্তা মিন অং হ্লাইংসহ অন্য সরকারি কর্মকর্তারা এসব দেশে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারছেন বিষয়টি এমন নয়। তাদের যাওয়ার জায়গা মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দেশ।

যেগুলো মধ্যে আছে আসিয়ান সদস্য থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়ার পাশাপাশি দুই বিশাল প্রতিবেশী চীন ও ভারত। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো জান্তা নেতাদের জন্য তার দরজা খুলে দিয়েছে ইরান।

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের শাসকরা পশ্চিমাদের কাছে অচ্ছুৎ হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়েছে ও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে জান্তা প্রধানদের পশ্চিমা দেশগুলোতে যাওয়া হয় না।

তাই তাদের সফর মূলত চীন ও রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ। এ বছর দুটি দেশেই ডজন খানেক করে ভ্রমণের রেকর্ড রয়েছে। প্রধান মিত্র এই দুই থেকেই জান্তা বেশিরভাগ অস্ত্র পেয়ে থাকে।

এ বছর চীন সফর করেছেন জান্তা বস মিন অং হ্লাইং, তার ডেপুটি সো উইন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টিন অং সান (যিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বদলি হয়েছেন) এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার পাই।

এর আগে বেইজিং জান্তা সরকারকে কিছুটা দূরে রাখার চেষ্টা করতো – শুধুমাত্র মিয়ানমারের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অথবা মন্ত্রিসভার কম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদেরকে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হতো। কিন্তু এ বছর কোন রাখঢাক না রেখেই জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং, তার ডেপুটি সোয়ে উইন এবং প্রথমবারের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন।

অভ্যুত্থানের পর থেকে আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দিতে পারছেন না মিন অং হ্লাইং। তবে, নভেম্বরের কুনমিংয়ে চীনের আয়োজিত গ্রেটার মেকং সাবরিজিয়ন সামিটে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে তিনি থাই, কম্বোডিয়ান এবং লাওসের মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান।

নেপিদো ও চীনের মধ্যে আলোচনাকারী জান্তা সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার পাই এবং সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টিন অং সান। তাদেরকে চীন ৫০০ মিলিয়ন ইউয়ান মানবিক সহায়তা দিয়ে পুরস্কৃত করে।

ক্ষমতা দখলের কয়েক মাস পর, ২০২১ সালের জুনে রাশিয়া প্রথম জান্তা বসকে মস্কোতে স্বাগত জানায়। জান্তার মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তখন থেকে মস্কো যাওয়া-আসা করছেন।

এ বছর মিন অং হ্লাইং রাশিয়া সফর করেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। তাই বলে দুই স্বৈর শাসনের মধ্যে সহযোগিতা শিথিল হয়নি। ২০২৪ সালে রাশিয়া সফরকারী জান্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান কো কো, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল কিয়াও সোয়ার লিন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মো অং-এর পাশাপাশি সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন, শিল্প, স্বাস্থ্য, আইন এবং হোটেল ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রীরা রয়েছেন।

এপ্রিলে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় রাশিয়া-মিয়ানমার সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির বৈঠকে যোগ দেন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ৩নং ব্যক্তি কিয়াও সোয়ার লিন। তিনি নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ এবং সামরিক প্রযুক্তিতে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন।

ভারত ২০২৪ সালে জান্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান শোয়কে দুবার স্বাগত জানিয়েছে। এর একটি ছিল বিমসটেক (বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের রিট্রিট। দিল্লি মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক রেখে চলছে এবং তারা জান্তার নির্বাচনী পরিকল্পনায় সহায়তা করছে।

জান্তা মন্ত্রী এবং জেনারেলদের প্রধান বিদেশী গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড, লাওস এবং কম্বোডিয়া। আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে রাজনৈতিক প্রতিনিধি পাঠানো নিষিদ্ধ হওয়ার পর জান্তা এই বছরের বৈঠকে স্থায়ী প্রতিনিধিকে পাঠায়।

জান্তা এয়ার ফোর্স প্রধান তুন অংকে স্বাগত জানিয়েছে থাইল্যান্ড। এই লোকটি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেসামরিক নাগরিক, স্কুল ও হাসপাতাল লক্ষ্য করে নির্বিচারে বোমা হামলা চালানোর জন্য দায়ী। এসিসট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স-এর মতে, ২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে বিমান হামলায় ১০৯ শিশুসহ ৫০৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

এছাড়াও ডিসেম্বরে ব্যাংকক সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থান সোয়ে। তিনি জান্তা সরকারের নির্বাচনী পরিকল্পনা নিয়ে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, লাওস এবং থাইল্যান্ডের উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ব্রিফ করেন।

জান্তার কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সোয়ে আসিয়ান দেশগুলো এবং রাশিয়া, চীন ও ভারতের পাশাপাশি ইরান সফর করেন। তিনি জুন মাসে তেহরানে মন্ত্রী পর্যায়ের ১৩তম এশিয়া সহযোগিতা সংলাপ (এসিডি) সভায় যোগ দেন। সফরকালে তিনি ইরান ও কাতারি প্রতিপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং জান্তার পদক্ষেপের ন্যায্যতা বুঝানোর চেষ্টা করেন।

এমন এক সময়ে জান্তা বিদেশে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছে যখন দেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। এই বছর তারা আরও ডজনখানেক শহর এবং ১৪টি আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের মধ্যে দুটি হারিয়েছে। এখন ৯০টিরও বেশি শহর প্রতিরোধ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

চীন ও রাশিয়ার মতো স্বৈরাচারী দেশগুলোর সমর্থনে টিকে থাকতে গিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

দি ইরাবতি, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ