সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলাকালে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আচরণ ছিল বেশ সংযত। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ মে এক বিবৃতিতে, তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া এবং আলোচনা করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের প্রশংসা করেন। ইউনূস বলেন, “কূটনীতির মাধ্যমে মতপার্থক্য নিরসনে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশীকে সমর্থন দিয়ে যাবে।” তার এই মন্তব্য, সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি ঢাকার অঙ্গীকারকে আরও শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি বৃহত্তর কৌশলগত হিসাব-নিকাশের প্রতিফলন – নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদ উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বাণিজ্য নির্ভরতা এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার কারণে ঢাকা ঐতিহাসিকভাবে বহু ক্ষেত্রে দিল্লির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তবে, সরকারের সর্বশেষ বিবৃতি জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন। ঢাকা কোনও পক্ষকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি বরং চেয়েছে কূটনৈতিক সংলাপ অব্যাহত থাকুক।
অপ্রয়োজনীয় সংঘাত এড়িয়ে বাংলাদেশ যেন বড় আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের সাথে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে এমন বাস্তববাদী পররাষ্ট্র নীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইউনূস প্রশাসন। জাতিসংঘ, বিমসটেক এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)’র মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর সম্পৃক্ততার মধ্যে বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ অবস্থানের প্রতিফলন ঘটে। সামরিক সংঘাতের পরিবর্তে কূটনীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে ঢাকা তার ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে।
যদিও সরকারী প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ মাপা কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সংকটকালে বাংলাদেশী জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ জটিল। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ক্ষত রয়েছে। এরপরও কিছু বাংলাদেশী ধর্মীয় সংহতির কারণে সাম্প্রতিক সংঘাতে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। একজনের মন্তব্য, “আমি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের বিরোধী হলেও আমি একজন মুসলিম হিসেবে [ভারতের সাথে] এই যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করি।”
অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচনায় ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশী জনগণের মধ্যে তীব্র হতাশা দেখা যায়। অনেকে নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র নীতি এবং অন্যদেশে হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত জনসাধারণের মন্তব্যে তাদের ক্ষোভ কতটা তীব্র তা প্রকাশ পায়: “সন্ত্রাসী ভারতকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ। হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী ভারত সবসময় পাকিস্তানকে ‘অহেতুক’ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে। অথচ, বাস্তবতা হল ভারত বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।”
এই ধরনের মন্তব্য থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশে এমন এক বয়ান তৈরি হচ্ছে যেখানে জনগণের মনোভাব কেবল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নয় বরং সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারাও প্রভাবিত হচ্ছে। ভারতের সীমান্ত নীতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর ভূমিকা এবং পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময়ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে বাংলাদেশী নাগরিক দাবি করে পুশ-ইন করার খবর জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। এদের যেভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের পরিবর্তে প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকা দিয়ে গোপনে পুশ-ইন করা হয় তাতে ঢাকা উদ্বেগ প্রকাশ করে। এই ঘটনা অভিবাসন এবং পরিচয় যাচাইয়ের বিষয়ে ভারতের নীতি নিয়ে বাংলাদেশে গভীর হতাশাকেও তুলে ধরে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সমস্যা দীর্ঘদিনের। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বারবার সীমান্ত উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। নথিবিহীন অভিবাসন, চোরাচালান এবং নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে প্রায়ই বিরোধ দেখা দেয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যেন সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয় সে জন্য ঢাকা বারবার ভারতকে অনুরোধ করে আসছে। এটা হতে হবে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে, একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে নয়। সাম্প্রতিক পুশ-ইনের ঘটনা বাংলাদেশী জনগণের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি এবং ভারত অন্যায্য আচরণ করছে বলে বদ্ধমূল ধারণা তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজের গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে হতাশা ব্যক্ত করছে। বিক্ষোভ-সামাবেশগুলোতে এই অঞ্চলে ভারতের কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। জনসমাবেশে “দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা”-এর মতো স্লোগান শোনা যাচ্ছে, যা বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনা পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দেয়।
তাই, ইউনূস প্রশাসনকে এই সংকট মোকাবেলায় সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল এবং নিরপেক্ষ রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে অবস্থান ধরে রাখতে পারে। জনসাধারণ ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থে বৃহৎ প্রতিবেশির সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। একই সাথে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা পাকিস্তানকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার বিকাশমান দৃশ্যপটে নিজ নিজ স্বার্থ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার মতো বিশ্বশক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তার প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করছে। পাকিস্তানও তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো কূটনীতি।
তাছাড়া, ঢাকার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল আঞ্চলিক সম্পর্ক প্রয়োজন। ভারত ও চীনের বিনিয়োগ, সেইসাথে পাকিস্তান এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য সতর্কতার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব থেকে উপকৃত হতে পারে।
কূটনীতির পক্ষে থেকে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আঞ্চলিক শান্তির প্রতি তার অঙ্গীকারও বজায় রেখেছে। তাই ভারত-পাকিস্তান সংকটকালে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত বিনির্মাণে ঢাকার ভূমিকা নির্ধারণে তার কৌশলগত অবস্থান হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ