জুলাই-আগস্টের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেনি, এটি দেশের দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও পাল্টে দিতে চলেছে।
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অনেক আওয়ামী লীগের বহু সদস্যকে জেলে পাঠানো হয় বা আত্মগোপনে চলে যায়। দলটির অবস্থা এখন নড়বড়ে এবং এর ভবিষ্যতও বেশ অন্ধকার।
১৯৭৫ সালের আগস্টে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এরপর প্রায় ১৫ বছর দেশটি একাধিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে এবং বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচাররা শাসন করেছে।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর থেকে ক্ষমতা দুটি প্রধান দল- হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মধ্যে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই থেকে কয়েক দশক ধরে দল দুটির মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে বামপন্থী সংগঠন পর্যন্ত ছোট দলগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার পরিবর্তে তাদের সমর্থক শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র মতো দলগুলো বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচন জোট গঠন করে বা পরবর্তীতে কিংমেকার হিসাবে কাজ করেছে।
এই ব্যবস্থা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছিল। এটি ছিল একটি স্থবির অবস্থা। সে কারণে তাদের রাজনৈতিক আলাপ ও আন্দোলনগুলো জনগণকে তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি।
কিন্তু হাসিনা-উত্তর যুগে সেই চিত্র বদলে গেছে।
আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। গত ১৫ বছর দলটি ক্ষমতায় থাকাকালীন বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম, দুর্নীতি এবং নির্বাচন জালিয়াতিসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কঠোরভাবে সমালোচিত এবং দলটি জনগণের মনে ঘৃণাও তৈরি করেছে। তবে, এর কট্টর সমর্থকরা আশা করছেন যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ পাওয়া গেলে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করবে।
অন্যদিকে, বিএনপি এখন বেশ চাঙ্গা এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনে এর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কিছু নেতা চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে দলটির ভাবমূর্তির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিএনপির নেতারা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী শতাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন।
সাম্প্রতিক ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান শুধু আওয়ামী লীগকে দুর্বল করেনি বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খুলে দিয়ে দুই দলের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের ঐতিহ্য নষ্ট করেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের একটি নতুন দল আত্মপ্রকাশ করবে।
নির্বাচনী ময়দানে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব বাংলাদেশের সামনে তার গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে। দুই দলের আধিপত্য ভেঙে নতুন দল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৃহত্তর প্রতিযোগিতা ও জবাবদিহিতা প্রবর্তন করতে পারে। এটি অন্যান্য তৃণমূল আন্দোলন ও সংগঠনকে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও অংশগ্রহণমূলক করতে পারে।
ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপি বা আ.লীগের সাথে জোট করা ছোট দলগুলো নতুন দলের দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে দুই বড় দলের আধিপত্য আরও খর্ব হতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক জোটের পুনর্বিন্যাস হবে এবং আরও গতিশীল রাজনৈতিক দৃশ্যপট রচিত হবে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থায় অনুগতদের নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রাজনীতিকরণে আ.লীগের শাসনামল ছিল নজিরবিহীন। অনেক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলা দলীয় কর্মীর মত কথা বলতেন। ছাত্র-অভ্যুত্থানের ফলে রাজনীতিতে বিঘ্ন ঘটা এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন নতুন দলের উত্থান এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কারণ নতুন দলটি এ ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকবে বলে আশা করা যায়।
শুধু সংসদের অভ্যন্তরে কি হয় তা একটি দেশের রাজনীতি নয়। সিভিক স্পেসে জনসাধারণের আলোচনায় প্রাধান্য বিস্তারকারীরাও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন ‘নাগরিক কমিটি’ ইতিমধ্যে নতুন, প্রতিভাবান এবং তরুণ মুখ নিয়ে কমিটি করেছে। তারা পাবলিক ফোরাম, টেলিভিশন টক শো এবং সংবাদপত্রে রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছে। এরা শহুরে তরুণদের আকৃষ্ট করছে।
ছাত্র-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান এবং এর থেকে জন্ম নেয়া দলটির বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জনানো, বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার সূচনা এবং আরও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বদলে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে।
তবে, এটিও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নতুন দলটিকে এমন এক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে কাজ করতে হবে যেখানে শাসকগোষ্ঠী প্রায়শই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া এবং সম্পদের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতে চায়। আবার মতাদর্শ এবং অগ্রাধিকারের প্রশ্নে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি ঝুঁকিও রয়ে গেছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ