১৩ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে “পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি”তে মধ্যস্থতা করার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি খারিজ করে দেয়। চুক্তিটি “দ্বিপাক্ষিক” ছিল বলে জানানো হয়।
একদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেন যে পাকিস্তানের সাথে সমস্ত লেনদেন হবে “কঠোরভাবে দ্বিপাক্ষিক”। নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের এই অবস্থানে “কোনও পরিবর্তন” হয়নি।
১০ মে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে মধ্যস্থতা করেছে। এর পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি তড়িঘড়ি এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে জানান যে পাকিস্তানের ডিজি মিলিটারি অপারেশন তার ভারতীয় প্রতিপক্ষের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং উভয় পক্ষ “জল, স্থল ও আকাশ পথে হামলা এবং সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করতে” সম্মত হয়েছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম নেননি।
তবে, এরপরও ট্রাম্প বারবার দাবি করতে থাকেন যে তার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে। সৌদি আরব সফরকালে যুদ্ধবিরতির জন্য “বাণিজ্যকে অনেকাংশে ব্যবহার করেছেন” বলে জানান। কাতারে গিয়ে বলেন যে তিনি “সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেছেন”। বাণিজ্যকে সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করার কথা এখানেও উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্পের এই দাবি নিয়ে ভারতের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার মুখে মার্কিন মধ্যস্থতার প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি সরকার নীরবতা ভাঙ্গতে বাধ্য হয়। সরকারের তরফ থেকে বলা হয় যে সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারত ও মার্কিন নেতাদের মধ্যে কথাবার্তা হলেও এই আলোচনার কোন পর্যায়েই বাণিজ্যের বিষয়টি আসেনি।
ভারত ও পাকিস্তান কিছু ঘোষণা করার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে নিজেকে “পিস মেকার” (শান্তির দূত) হিসেবে তুলে ধরার বিষয়টি ট্রাম্পের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে।
তবে তার বক্তব্যকে যেকোন যুক্তিতে উড়িয়ে দেয়া গেলেও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্তা ছিল নয়াদিল্লির সরকারী অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। এটাই উদ্বেগের বিষয়।
ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কীভাবে ভারতীয় ও পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর – ১০ মে “ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মার্কিন-লঙ্ঘিত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা” শীর্ষক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। পরে, রুবিও এক্স হ্যান্ডেলে-এ ঘোষণা করেন যে ভারত ও পাকিস্তান সরকার একটি নিরপেক্ষ স্থানে বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে রাজি হয়েছে।
অবশ্য টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে মোদি এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন এবং নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আলোচনা ও রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ একসাথে চলতে পারে না।
মোদির বক্তব্য সাময়িকভাবে হলেও জনগণের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করেছে কিন্তু যেসব প্রশ্ন রয়ে গেছে – এটি কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের জোরালো সম্পর্ককে লাইনচ্যুত করবে? বর্তমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কি চলমান বাণিজ্য আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রশমিত হবে?
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে ওয়াশিংটনের সাথে বাণিজ্য চুক্তির কাছাকাছি থাকা কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারতও রয়েছে। মোদির সাথে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ভ্যান্স গত মাসে নয়াদিল্লি সফর করেন এবং উভয় নেতাই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির প্রথম পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান।
দোহায় ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে সাম্প্রতিক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন যে ভারত মার্কিন পণ্যের উপর কোনও শুল্ক ছাড়াই একটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের জয়শঙ্কর দ্রুত এই দাবি খারিজ করে দিয়ে বলেন যে আলোচনা এখনও চলছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিশেষ করে শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না।
বর্তমান উত্তেজনা ভারতীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের ১৭ মে থেকে শুরু হওয়া চার দিনের ওয়াশিংটন সফরকে প্রভাবিত করবে বলে মনে হয় না। তিনি মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার এবং বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিকের সাথে আলোচনায় বসবেন। ভারতীয় আমদানির উপর অতিরিক্ত ২৬ শতাংশ মার্কিন শুল্ক এড়াতে নয়াদিল্লি একটি বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করতে আগ্রহী। পাল্টা শুল্ক আরোপ স্থগিতের মেয়াদ ৯ জুন শেষ হবে। তাই, নয়াদিল্লির জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতির চাপকে বাণিজ্য ইস্যুর সাথে যুক্ত করে ট্রাম্প নয়াদিল্লির অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে তিনি কূটনীতির সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাকে কার্যকরভাবে একীভূত করতে পেরেছেন।
তবে, বাণিজ্যে সুবিধা পেলেও ট্রাম্পের মন্তব্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা মোদির পক্ষে কঠিন হবে। যা নিয়ে আলোচনা সেটা এমন এক চুক্তি যেখানে ভারতকে মার্কিন শুল্ক দাবির কাছে অতিরিক্ত নতি স্বীকার করতে দেখা যাচ্ছে। ভারতের বাণিজ্য নীতি মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ওয়াশিংটন সফল হয়েছে। এটা ভারতের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হবে। এতে আলোচনায় নয়াদিল্লি বেশ নাজুক অবস্থানে থাকবে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দিল্লির অনেকেই কোয়াডের (যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান) নীরবতা লক্ষ্য করেছেন এবং সঙ্কটের সময়ে এই জোটের সদস্যদের উপর নির্ভর করা যাবে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। তাই নয়াদিল্লিতে মার্কিন বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। জনগণ মোদির যুদ্ধবিরতিকে আমেরিকান চাপের কাছে নতি স্বীকার বলে মনে করছেন।
কাশ্মীর ভারতের জন্য বিশেষভাবে আবেগপ্রবণ একটি বিষয়। তাই বিহারে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে মোদি জনগণকে শান্ত করার জন্য প্রবল চাপে পড়বেন।
নয়াদিল্লি আগামী কয়েক সপ্তাহ ওয়াশিংটনের পদক্ষেপগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। ইসলামাবাদকে এবং নয়াদিল্লিকে “ডি-হাইফেনেশন” করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন বুশ। এর বিপরীতে ট্রাম্প দুই দেশকে আবারো “হাইফেন” করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে ভারত-মার্কিন অংশীদারিত্বের জন্য একটি গুরুতর ধাক্কা।
তাহলে, এই ভারত-পাকিস্তান সংকট কি বিশ্বের দুটি বৃহত্তম গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে মৌলিকভাবে বদলে দেবে?
অতীতে নয়াদিল্লি, নিরাপত্তাকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার জন্য ওয়াশিংটনের প্রকাশ্য সমালোচনাকে আমলে না নিয়েও চলতে পেরেছিল।
হয়তো, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উত্থান মোকাবেলায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে না আমেরিকা। এরপও তাদের সম্পর্কের অবনতি রোধ করতে পারে শুধু সংলাপ ও কূটনীতি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ