দক্ষিণ এশিয়ার দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাত ছিল বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর। সংঘাতে দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ প্রথমবারের মতো পরস্পরের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করেছে।
বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলি নজরদারি থেকে নাশকতা, টার্গেটেড কিলিংসহ আরও অনেক কাজে ক্রমবর্ধমান হারে ড্রোন ব্যবহার করছে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শুরু করে লোহিত সাগর পর্যন্ত, সারা বিশ্বে সামরিক সংঘাতে ড্রোনের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাক-ভারত সংঘাতে ড্রোনের সম্পৃক্ততা দেশগুলির জটিল শত্রুতার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভবিষ্যতের যেকোনো সামরিক সংঘাতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টারের ‘প্রজেক্ট ফর ম্যানেজিং দ্য অ্যাটম’-এর ভিজিটিং ফেলো রাবিয়া আখতার বলেন, “এই সামরিক সংঘাতে ড্রোনের ব্যবহার দক্ষিণ এশীয় যুদ্ধের চরিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এতদিন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছিল। আগামীতে পাক-ভারতের মধ্যে ছোটখাট সংঘাতেও এই অস্ত্র ব্যবহার স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হবে। এমন নয় যে আগে তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারে এটি ছিল না।”
পাক-ভারত সংঘাতে ড্রোনের ব্যবহার ইতোমধ্যে কিছু বিতর্ক উষ্কে দিয়েছে। যেমন কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অন্যান্য অস্ত্রের তুলনায় ড্রোন কম ধ্বংসাত্মক। বিশেষ করে, পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো যখন সংঘাতে লিপ্ত হয়।
যদিও পাক-ভারত সংঘাতের রূপটি পুরোপুরি স্পষ্ট নয় এবং বিশ্লেষকরা এখনও অনেক কিছু বোঝার অপেক্ষায় আছেন কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট: ড্রোন ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো সংঘাতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, এটি দামে সস্তা, নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং যুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গ রূপ না দিয়ে রাজনৈতিক বার্তা পাঠানোর জন্য একটি যুৎসই হাতিয়ার।
যুদ্ধবিরতি ধীরে ধীরে উত্তেজনা কমিয়ে আনলেও কী পদ্ধতিতে, কোন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া এখনো কঠিন। কিন্তু উভয় পক্ষই আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে, যা কামিকাজে ড্রোন নামেও পরিচিত। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায়শই এ ধরণের একমুখী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো এবং প্রতিরক্ষা প্রোগ্রামের পরিচালক স্ট্যাসি পেটিজন বলেন, “উভয় পক্ষই কামিকাজে ড্রোন বা একমুখী আক্রমণাত্মক ড্রোন ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে, যা আরেকটি বৈশ্বিক প্রবণতা।”
তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেনের বাইরে, ইরান এবং তার প্রক্সি, যেমন ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা চালাতে, সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি এবং ইসরাইলে হামলা চালাতে আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করেছে।
পেটিজন বলেন, এই ধরণের ড্রোন প্রায়ই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এরপরও এগুলো বৃহৎ পরিসরে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইন্টারসেপ্টরের ভাণ্ডার খালি করে দেয়।
বিভিন্ন রিপোর্টের বরাত দিয়ে মার্কিন নৌবাহিনীর ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা ম্যাটিসেক বলেন, প্রতিপক্ষের উপর হামলা করতে ভারত ইসরাইলের তৈরি হারোপ এবং গোয়েন্দাগিরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হেরণ ড্রোন ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান সম্ভবত তুর্কি বায়রাক্তার টিবি২ এবং আকিনতি ড্রোন ব্যবহার করেছে। সেই সাথে ছিল চীনা উইং লুং-২ ও সিএইচ-৪।
ভারত দাবি করে যে তারা পাকিস্তানে জঙ্গি অবকাঠামো লক্ষ্য করে হারোপের মতো যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান তুলনামূলক সস্তা সিস্টেমের উপর নির্ভর করেছে, যেগুলো দ্রুত যেকোন টার্গেটে হামলা করতে সক্ষম। এসব ড্রোন ভারতের প্রচলিত সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে খাটো করে দিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ প্রমাণ করছে যে বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র সংঘাতে ড্রোন পছন্দের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। ড্রোন আগের চেয়েও নিখুঁত ও মারাত্মকভাবে শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারে। শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুঁজে বের করে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে ড্রোনের ঝাঁক অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের প্রথম দশকে ড্রোনের উপর প্রায় একচেটিয়া অধিকার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এখন সেই অবস্থা নেই। এখন দ্রুত গতিতে ড্রোনের বিস্তার ঘটছে এবং বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন আকার ও শক্তির ড্রোন দিয়ে তাদের অস্ত্রাগার পূর্ণ করছে।
ম্যাটিসেক বলেন, পাক-ভারত সংঘাতের গতি এবং কৌশল নির্ধারণে ড্রোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এর ফলে দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিদ্বন্দ্বী কীভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
তার মতে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এটি শুধু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছিল না – এটি ছিল প্রতীকী। ড্রোনগুলি কৌশলগত সংকেতের হাতিয়ার হয়ে ওঠেছে। দেখা যাচ্ছে, উভয় পক্ষের এখন এমন আকাশ শক্তি রয়েছে যা স্থায়ী, সুনির্দিষ্ট এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে সস্তা।
ম্যাটিসেক বলেন, চার দিনের সংঘাতে ড্রোনের উপর অত্যধিক নির্ভরতা সংঘাতকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হতে দেয়নি। এই সংঘাতে ড্রোনের ব্যবহার বেপরোয়া নয়, বরং সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল। এতে মনে হয়, উভয় সরকারই ড্রোনকে যুদ্ধ জয়ের প্ল্যাটফর্মের পরিবর্তে উত্তেজনা ব্যবস্থাপনার হাতিয়ার হিসেবে দেখেছে।
পেটিজন বলেন, “যদিও পাকিস্তান কিছু ব্যয়বহুল ইসরাইলি-নির্মিত হেরন ড্রোন ভূপাতিত করেছে, তবে তা ভারতের জন্য যুদ্ধবিমান হারানোর মতো বড় ক্ষতিকর ছিল না।”
অবশ্য কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন যে লাল রেখা অতিক্রম না করে উস্কানির প্রতিক্রিয়া জানানোর কার্যকর উপায় হিসেবে ড্রোনকে বিবেচনা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
আখতার সতর্ক করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ড্রোনকে কম আক্রমণাত্মক হিসাবে ধারণা করা বিশেষভাবে “বিপজ্জনক”। এই অঞ্চলটি বহুমুখি আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, “সময়ের পরিক্রমায় ড্রোন প্রযুক্তি যত বেশি নিখুঁত ও স্বাধীন হবে, কৌশলগত লাভ ও কৌশলগত ভুলের মধ্যে রেখাটি তত ঝাপসা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই সংকট যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তা হল ড্রোন কেবল কৌশলগত অস্ত্র নয় – এগুলো এখন উভয় দেশের জন্য কৌশলগত সংকেত প্রদানকারী সরঞ্জামে পরিণত হয়েছে।
ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ