বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তার পুরানো ফাইটার জেট বহর বদলে ফেলার কথা ভাবছে। আর এ ক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে চীনের জে-১০সিই। ৪.৫-প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার জেটগুলো প্রতিবেশী ভারতের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান গত মাসে চীন সফর করার পর দেশে ফিরে সাংবাদিকদের জানান যে ঢাকা “মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার সংগ্রহের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিত্রে ভারতীয় প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ডিফেন্স রিসার্চ উইংয়ের এক প্রতিবেদনে এ নিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আপগ্রেডের প্রথম ধাপে ১৬টি জে-১০সিই কিনতে পারে, এটা জে-১০সি’র রফতানি সংস্করণ।
সফরকালে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্যিক বিমান প্ল্যাটফর্মের প্রদর্শনী ঝুহাই এয়ার শোতে অংশ নিয়েছেন জনাব খান।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, চীনের সঙ্গে “বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার” এবং সহযোগিতার পরিধি আরো বিস্তৃত করাই ছিল বিমান প্রধানের চীন সফরের লক্ষ্য।
তিনি চীনের ন্যাশনাল অ্যারো-টেকনোলজি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএটিআইসি) এর সদর দফতর পরিদর্শন করেন। এটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
চীন থেকে জে-১০সি ফাইটারের প্রথম ক্রেতা পাকিস্তান। দেশটি চীনের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারও বটে। এর পরেই অবস্থান বাংলাদেশের।
মাল্টিরোল ফাইটার জেটের পারফরম্যান্স দেখার জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চীনে প্রতিনিধি দল পাঠায়।
তবে, অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ঢাকা অব্যাহতভাবে চীনের দিকে ঝুঁকলেও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির পুরনো জঙ্গি বিমান বহর পরিবর্তনের জন্য জে-১০সি একমাত্র বিকল্প নয়।
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যান্ড কর্পোরেশনের সিনিয়র আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা গবেষক টিমোথি হিথ বলেন, “চীনের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তাই বাংলাদেশ জে-১০সি কেনার চেষ্টা করতে পারে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
হিথের মতে বাংলাদেশের পুরনো ফাইটার জেটগুলো বদলে ফেলা জরুরি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জে-১০সি কেনার সামর্থ্য রাখে। তবে এর বর্তমানে যতগুলো জে-৭ ফাইটার রয়েছে ততগুলো না কিনলেও চলবে। ঢাকা অন্যান্য মডেলের ফাইটার কেনার বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে।”
জে-১০সি ভিগোরাস ড্রাগন ফাইটারগুলোকে আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ ফাইটারের সাথে তুলনা করা হয়। এগুলো ২০১৮ সালে চীনা বিমান বাহিনীর বহরে প্রথম যুক্ত হয়।
এটি ৪.৫-প্রজন্মের মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট জে-১০’র একটি ভেরিয়েন্ট। চীনের তৈরি ডব্লিউএস-১০বি ইঞ্জিনে চলে এই ফাইটার জেট।
ফ্লাইটগ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৬টি এফ-৭ এমজি ফাইটার রয়েছে। এফ-৭ এমজিগুলো বাংলাদেশের জন্য ডিজাইন করা জে-৭ সিরিজের একটি ডেরিভেটিভ।
চীনে থেকে কে-৮ প্রশিক্ষন এয়ারক্রাফ্টও কিনেছে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশটি চীন থেকে ট্যাঙ্ক, জাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, চীন বাংলাদেশকে ২০০৬ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় ১৬টি এফ-৭এমজি ফাইটার দিয়েছে।
নানয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো কলিন কোহ বলেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তার “মেইনস্টে ফাইটার” হিসেবে রাশিয়ান-ডিজাইন করা মিগ-২৯ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, এফ-৭ এমজি হলো সেকেন্ড-লাইন ফাইটার।
বাংলাদেশ মিগ-২৯ এবং এফ-৭ পরিবর্তনের জন্য ব্যয়বহুল পশ্চিমা মডেল সংগ্রহ করতে না চাইলে চীনের পাশাপাশি রাশিয়ান বা এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ান মডেলও বিবেচনা করতে পারে বলে কোহের অভিমত।
তবে, সিউলের সাথে ঢাকার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক নেই এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার রপ্তানি ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাই চীনের জে-১০ সিরিজকে তিনি “একটি যৌক্তিক বিকল্প” হিসাবে দেখছেন।
পিপলস লিবারেশন আর্মির সাবেক প্রশিক্ষক এবং প্রতিরক্ষা ভাষ্যকার সং ঝংপিং’র মতে, বাংলাদেশ জে-১০ সি কিনতে চাইলে চীন স্বাগত জানাবে। তবে ঢাকার নিরাপত্তা ঝুঁকি যে স্তরের তাতে এত উন্নত ফাইটার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, তৃতীয় প্রজন্মের মাল্টিরোল ফাইটার এফসি-১ দিয়ে জে-৭ ফাইটাকে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। জে-১০সি দিয়ে সেগুলো প্রতিস্থাপন করা হলে তা হবে আরো এক প্রজন্ম এগিয়ে যাওয়া। জে-১০সি’র দাম এফসি-১-এর প্রায় দ্বিগুণ।
তবে হিথ মনে করেন, বাংলাদেশ যদি ৪.৫-প্রজন্মের জে-১০সিই বেছে নেয়, তবে সেটা হবে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত। তিনি আশঙ্কা করছেন এতে সম্ভবত ভারত ক্ষুব্ধ হবে। দিল্লি তার সীমান্তবর্তী দেশগুলো সাথে চীনা সামরিক সহযোগিতা সহজে মেনে নিতে চাইবে না।
তখন ভারতের প্রতিবেশী দেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হবে চীনের চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটার সংগ্রহকারী দ্বিতীয় রাষ্ট্র। এতে বেইজিং এবং নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে।
মিশর তার পুরনো এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন বহর প্রতিস্থাপনের জন্য জে-১০সি কেনার অর্ডার দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দেশটির সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ