পাঁচ দশক পর, গত নভেম্বর বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি পাকিস্তানি পণ্যবাহী জাহাজ নোঙ্গর করেছে। জাহাজটির আগমন পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ঢাকা নাকি ইসলামাবাদ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার কথা ভাবছে এবং পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক পরিদর্শনে কড়াকড়িও আগের চেয়ে শিথিল করা হয়েছে।
কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানাক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এই বিষয়গুলো এসেছে। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সর্বসম্মত প্রার্থী হিসেবে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউনূস দেশটির হাল ধরেন। ক্ষমতার শেষ দুই মেয়াদে হাসিনা ভারত সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। (হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে নয়াদিল্লি এবং তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ঢাকা সম্প্রতি ইন্টারপোলকে রেড নোটিশ জারি করতে বলেছে।)
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ভারতকে নির্বাক এবং হতভম্ব করে দেয়। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল হিমশীতল। ফলস্বরূপ, নয়াদিল্লী এখন বাংলাদেশে তেমন কোন মিত্র খুঁজে পাচ্ছে না। ইউনূস ভাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে তার আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও পাকিস্তানের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে ভারতে প্রবল দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে, ভারত এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিভাষায় ‘পররাষ্ট্র-নীতি পুনর্বিন্যাস‘ পরিস্থিতির সম্মুখিন। এই পরিবর্তনগুলোর বেশিরভাগই দুটি উত্স থেকে সৃষ্ট: বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন যা একটি দেশকে তার অগ্রাধিকার ও কৌশল অথবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরিবর্তনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়টি, স্পষ্টতই ঢাকার পররাষ্ট্র-নীতির অরিয়েন্টেশনে নাটকীয় পরিবর্তন, যার প্রভাব নয়াদিল্লির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা হাসিনার আমলে দুই দেশের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ (যাকে ইংরেজিতে বলে সিম্বিয়াটিক) সম্পর্ক ছিল। হাসিনা বাংলাদেশের ইসলামপন্থী শক্তিকে দমিয়ে রেখেছিলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে আশ্রয় দেননি এবং ভারতীয় বিনিয়োগ স্বাগত জানিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে, নয়াদিল্লি হাসিনার বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অভিযোগ আমলে নেয়ার গরজ অনুভব করেনি। বাণিজ্য, আন্তঃসীমান্ত রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়ানোতে মনযোগ ছিল নয়াদিল্লির ।
এরপরও দ্বিপাক্ষিক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছু অন্তর্নিহিত টানাপোড়েন এই সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করেছিল। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলো সামনে চলে এসেছে। এগুলো সম্ভবত উভয় পক্ষকে অগ্রাধিকার পুনর্মূল্যায়নের দিকে পরিচালিত করবে।
ভারত মনে করে ঢাকায় যে সরকারই থাকুক না কেন, বিশেষ করে ২০২৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে, বাংলাদেশ থেকে অনিয়মিত অভিবাসন সর্বদাই একটি জটিল সমস্যা। হাসিনা সরকারও এই ইস্যুতে তেমন কথা বলেনি। বিজেপি বিষয়টিকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করে। বিশেষ করে, ভারতে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে দলটির অস্থিরতর পেছনে মূলত ধর্মীয় পরিচয় এবং ইসলামফোবিয়াকে দায়ী করা যেতে পারে।
উত্তেজনা এখন বাড়ছে: নভেম্বরে বাংলাদেশে একজন হিন্দু ধর্মীয় নেতার গ্রেপ্তারকে ঘিরে বিক্ষোভ হয়। তখন দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে তাদের সীমান্তের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তোলে।
ভুল তথ্যের মাধ্যমে এই ধরনের শত্রুতা আরও তীব্র হয়। কিছু ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে এবং গুজব ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আবার ঢাকাও নিঃসন্দেহে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি তার আচরণের জন্য নয়া দিল্লিকে আক্রমণ করবে-যার ফলে শত্রুতা বেড়ে যাবে।
আরেকটি ইস্যুতে উভয় পক্ষ একমত হতে ব্যর্থ হয়েছে –
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুও দুই দেশের সম্পর্কে কাঁটা হয়ে আছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সম্মতি না থাকায় চুক্তি করতে পারেনি বলে দিল্লি অযুহাত দেয়। এই ইস্যুটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী শক্তির জন্য একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কিছু বিষয় সবসময় নয়াদিল্লির ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর জন্য চিন্তার কারণ হয়েছে। একটি হলো বাংলাদেশে ’ইসলামপন্থীদের’ উত্থান এবং দেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর এর বিরূপ প্রভাব। যারা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করেছিল তাদের মধ্যে ইসলামপন্থী এবং ভারত বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এখন উচ্ছ্বসিত বোধ করছে।
এর প্রভাব ভারতের নিজস্ব মুসলিম সম্প্রদায়, বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তে বসবাসরত মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতের প্রধান বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা – রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (’র’), দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবর্তনের উপর গভীর নজর রেখেছে। বিজেপির বৃহত্তর হিন্দু সমর্থক-গোষ্ঠীর পরিপ্রেক্ষিতে ‘র’ বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে নিরুদ্বেগ থাকতে পারে না। তবে এই মুহুর্তে, পরিস্থিতি যাইহোক, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি ঘটালে তা ভারতের জন্য অবশ্যই হিতে বিপরীত হবে।
অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে হাসিনার দল আওয়ামী লীগের মাথা তোলার সুযোগ নেই এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলে বিএনপি’র নতুন সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল। দলটির সাথে ভারতের টানাপোড়েনের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক বৈদেশিক-নীতির পছন্দগুলো দেখে মনে হচ্ছে আগামীতে বাংলাদেশের মনোভাব পরিবর্তন করতে ভারত সক্ষমতা বেশ সঙ্কুচিত হয়ে আসবে।
বাংলাদেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামায়াত-ই-ইসলামী যদি অতীতের মতো বিএনপির সঙ্গে জোট বাধে, তাহলে পররাষ্ট্র-নীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন এই ক্রমবর্ধমান শত্রু প্রতিবেশীকে নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়বে বৈ কমবে না। এই সম্ভাব্য ফলাফল ঠেকানোর জন্য নয়াদিল্লির হাতে অস্ত্র তেমন কিছুই নেই; অন্যসব দল বাদ দিয়ে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা তাকে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলেছে।
ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ