সিরিয়ায় আসাদের পতন: কাশ্মীর প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারালো ভারত

সিরিয়ায় আসাদের পতন: কাশ্মীর প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে হারালো ভারত

সিরিয়ার অভ্যুত্থান নয়া দিল্লির জন্য বেশ বড় ধরনের সমস্যা বয়ে এনেছে: কাশ্মীর প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম “কণ্ঠস্বরকে” হারিয়েছে ভারত।

নয়াদিল্লি যদিও দীর্ঘদিন ধরে বলেছে যে কাশ্মীর বিরোধ তার এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয়, কিন্তু জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের প্রতি সিরিয়ার ধারাবাহিক সমর্থনকে বড় ধরনের জয় হিসাবে দেখা হয়েছিল।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ এবং দিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্কে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর কবির তানেজা বলেন,”আরব মুসলিম বিশ্বের মধ্যে থেকে সমর্থনের এই কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” বাশার আল-আসাদের অধীনে, সিরিয়া বারবার নিশ্চিত করেছে যে কাশ্মীর একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান করা।

এখন আসাদের পতনে সেই সমর্থনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বিরোধী বাহিনী গত সপ্তাহান্তে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখল করে নিলে আসাদ পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। আসাদ পরিবারের কয়েক দশকের শাসনামলে গৃহযুদ্ধে দেশটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

সিরিয়ায় ঘটনাবলীর নাটকীয় মোড় দিল্লিকে হতচকিত করেছে। অথচ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও সিরিয়া সরকারের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে।

১৩ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের বেশিরভাগ সময়ে সিরিয়ার সংঘাতে ভারত “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি” দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।

দামেস্ক রণক্ষেত্র হয়ে উঠলেও সেখানে ভারতীয় দূতাবাস খোলা ছিল। এটি ভারতের সদিচ্ছার লক্ষণ ছিল বলে তানেজা  মনে করেন। আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্কও টিকে ছিল। আসাদের আস্থাভাজন সিরিয় কর্মকর্তা বুথাইনা শাবানসহ নিয়মিত দিল্লি সফর করতেন, যা দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন তুলে ধরে।

কিন্তু আসাদের পতন ভারতের উপর কিছু প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলো এক সময় সিরিয়ার তেলক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছিল। তবে এক দশকেরও বেশি আগে সেই কাজগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। সিরিয়ায় ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যাও হাতে গোনা – জাতিসংঘের কর্মীসহ “কয়েক ডজন” মাত্র।

এরপরও উদ্বেগ রয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে সিরিয়ায় ক্ষমতার শূন্যতা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে উত্সাহিত করতে পারে। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দানকারী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর উৎপত্তি আল-কায়েদা থেকে।

দিল্লি-ভিত্তিক আরেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের  গবেষণা ফেলো পবন চৌরাসিয়া বলেন, ” এইচটিএস সিরিয়ায় একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়া এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল হতে পারে এবং বৈশ্বিক জিহাদি আন্দোলনের জন্য চ্যালেঞ্জ হাজির করতে পারে।”

তিনি সিরিয়া সংঘাতের প্রথম দিকে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের দিকে ইঙ্গিত করেন, যা ভারতসহ সারা বিশ্ব থেকে তরুণদের দলে টানে। ” এবারও একই রকম উদ্বেগ রয়েছে এবং ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এটা চাইবে না।

সিরিয়ায় এইচটিএস এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর শক্তি অর্জনের সম্ভাবনা ভারতের জন্য উদ্বেগের একটি অতিরিক্ত স্তর বহন করে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আসাদের পতনের পতন এবং কাশ্মীর নিয়ে তার ভারতপন্থী অবস্থানকে  – কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীরা দিল্লির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ব্যবহার করতে পারে বলে চৌরাসিয়া সতর্ক করে দেন।

তিনি বলেন, এইচটিএস এই সমস্যাটিকে তার “বিশ্বাসযোগ্যতা” শক্তিশালী করতে ব্যবহার করতে পারে – দেখাতে পারে যে “ইসলামী মূল্যবোধ এবং ভ্রাতৃত্ব” প্রশ্নে তারা আসাদ সরকার থেকে আলাদা।

এটা কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরদার করে তোলার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

চৌরাসিয়া বলেন, “আসাদের পতন এবং এইচটিএসের উত্থানকে দক্ষিণ এশিয়ায় কিছু ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিজেদের কার্যক্রম জোরদার করার একটি সংকেত হিসেবে দেখতে পারে।”

তবে কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে পশ্চিম এশিয়ার পরিবর্তনশীল বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পথ খুঁজে পাবে দিল্লি।

সৌদি আরব এবং ইরানের মতো প্রতিপক্ষের পাশাপাশি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় দিল্লির ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে রাশিয়ার আদিঘে স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ লিসা আইজ্যাক বলেন, “ভারত সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো কার্যকরভাবে নেভিগেট করবে।”

তবে সব বিশ্লেষকই আশাবাদী নন। চৌরাসিয়া সতর্ক করে দেন যে আসাদের পতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে সিরিয়া এবং ভারত উভয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের প্রতি মনোযোগী হতে উত্সাহিত করতে পারে।

তিনি বলেন, ” ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে তাহলে এটা ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এটি সম্ভবত দিল্লিকে পক্ষ নিতে বাধ্য করবে।

বুধবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি দাবি করেছেন যে আমেরিকা ও ইসরায়েলের চালে আসাদের পতন ঘটেছে।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে প্রমাণ আছে এবং এই প্রমাণ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।”

গত সপ্তাহে, দিল্লি সিরিয়ার অভ্যুত্থানের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে ওকালতি করে। কিন্তু “মহৎ উদ্দেশ্য” থাকলেও সিরিয়ার “ভবিষ্যত ঠিক করতে” ভারত সাহায্য করতে পারবে না বলে চৌরাসিয়া মনে করেন- শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশগুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সেটা করতে পারবে।

আপাতত, ভারত তাৎক্ষণিক উদ্বেগের প্রতি মনোনিবেশ করছে। বুধবার, সিরিয়া থেকে তার ৭৫ জন নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে। এসব নাগরিক সিরিয়া থেকে লেবাননে প্রবেশে করেছে ভারতমুখি ফ্লাইট ধরবে বলে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ