নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির আসন্ন চীন সফর নেপালের বৈদেশিক নীতিতে একটি কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে: হিমালয় কন্যা নতুন দিল্লির কার্যক্রমে হতাশ হয়ে বেইজিংয়ের পথ ধরেছে বলে মনে হয়।
যদিও ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সফর চীনের সাথে নেপালের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার প্রমাণ, তবে এতে ভারতের সাথে তার ঐতিহ্যগত সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার জটিলতাও ফুটে উঠে।
অলি এবার ক্ষমতায় এসে প্রথম বিদেশ জন্য চীনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত নেপালের নেতাদের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যের ছেদ। নেপালে প্রধানমন্ত্রীরা এতদিন ভারতের সঙ্গে নেপালের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে প্রথমে নয়াদিল্লি সফর করে আসছিলেন।
যাইহোক, গত কয়েক মাস ধরে ভারতীয় নেতৃত্ব যেভাবে নেপালীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আসছেন- জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে অলির আমন্ত্রণে শীতল মনোভাব দেখান- তাতেই ভরকেন্দ্রটি চীনের দিকে ঘুরে গেছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে নেপালি নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালে ঐতিহাসিক ট্রানজিট এবং ট্রান্সপোর্টেশন চুক্তি স্বাক্ষর থেকে শুরু করে ২০১৯ সালে নেপালে শি’র রাষ্ট্রীয় সফর আয়োজন করা পর্যন্ত তার মেয়াদে নেপাল-চীন সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো ভারতের উপর নেপালের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে অলির বৃহত্তর কৌশলের অংশ। বিশেষ করে ২০১৫ সালে নয়াদিল্লি আরোপিত অবরোধ নেপালের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক প্রভাব কাঠমান্ডুর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে কিন্তু এর সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। বিশেষজ্ঞরা এই বলে সতর্ক করছেন যে, ভারতকে উপেক্ষা করার নেপালের প্রচেষ্টা তার দক্ষিণ প্রতিবেশীকে ক্ষুব্ধ করতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতের সঙ্গে নেপালের সাথে বাণিজ্য ৮.৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অথচ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলারের।
অলির কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপালের (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিষ্ণু রিজাল বলেন, বেইজিং কাঠমান্ডু ও নয়াদিল্লির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভেদকে কাজে লাগাতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, “চীন ভারত-নেপাল সম্পর্কের শূন্যতা পূরণ করতে আগ্রহী। এই কৌশলগত দূরত্ব চীনের জন্য একটি সুযোগ, বিশেষ করে যদি ভারতের বিরুদ্ধে সমালোচনা তীব্র হয়ে উঠে।”
অলির বেইজিং এজেন্ডা উচ্চাভিলাষী। এতে চীন-নির্মিত পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য ২১৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ মওকুফ নিয়ে আলোচনা এবং আটকে থাকা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঋণের জন্য চীনের ওপর নেপালের নির্ভর করা কতটা টেকসই হবে সেই প্রশ্ন উঠেছে। চীনা “ঋণের ফাঁদ” সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়ছে, অনেকে উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরকে উল্লেখ করেন।
চীনা বিশেষজ্ঞরা নেপালের ঋণ মওকুফের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান। সিচুয়ান ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের নেপাল স্টাডি সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর গাও লিয়াং বলেছেন: “ব্যক্তিগতভাবে, আমি মনে করি না এটা সম্ভব হবে। এই ধরনের অনুরোধ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাজারে নেপালের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে না।”
গাও বলেন, নেপালকে মওকুফ করা হলে তা একটি খারাপ নজির স্থাপন করতে পারে। পরিবর্তে, তিনি পরামর্শ দেন যে নেপালকে বাস্তবসম্মত বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে, যেমন ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে আলোচনা (যা ২০২৬ সালে শুরু হওয়ার কথা) বা উভয় দেশ রাজি হবে এমন বিকল্প পরিশোধ পদ্ধতির প্রস্তাব করা।
ক্রমবর্ধমান চীনা বিনিয়োগ সত্ত্বেও, নেপালের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ভারত গভীরভাবে মিশে আছে। পাইপলাইন থেকে ট্রান্সমিশন লাইন পর্যন্ত, ভারতের কানেকটিভিটি প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিপরীতে বিআরআই প্রকল্পগুলো বিলম্বিত হচ্ছে এবং এগুলো জটিল।
ভারত-চীন সম্প্রীতি
এমন এক সময় অলির সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা অনেকটাই নিরসন হয়ে গেছে। এই সম্প্রীতি এক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অন্য প্রতিবেশীকে কাজে লাগাতে কাঠমান্ডুর লিভারেজ দুর্বল করে দিলেও এটি বাণিজ্য, শক্তি এবং অবকাঠামোতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার দরজা খুলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-চীন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে পারে। এতে নেপালের মতো ছোট দেশগুলো উপকৃত হবে। তবে এই ভারসাম্য রক্ষা খুব সহজ নয়।
পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ রূপক সাপকোটা বলেন, “ভারতের বিকল্প হিসেবে চীনকে বেছে নেয়া নেপালের জন্য ক্ষতিকর হবে। পরিবর্তে, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, উভয় দেশের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখা যায় এমন ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।”
“ঐতিহাসিকভাবে, ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি হলে নেপাল চীনের দিকে ঝুঁকেছে, কিন্তু আজকের জটিল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এই প্রতিক্রিয়াশীল কৌশল আর কার্যকর নয়।”
চীনের সাথে নেপালের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। বেইজিংয়ের অবকাঠামো কূটনীতি এই অঞ্চলকে বদলে দিচ্ছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেপালের জন্য সুযোগ তৈরি করলেও ঝুঁকিও আছে। কারণ, দেশটি স্বাধীনভাবে উন্নয়ন উচ্চাকাঙ্ক্ষার হাসিল করতে চায়।
অলির পূর্বসূরি পুষ্প কমল দহলের পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন সাপকোটা। তিনি বলেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বা চীনের গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে যোগ না দিয়ে নেপাল কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নীতি অবলম্বন করেছে।
ভারতের সামরিক নিয়োগ কর্মসূচি ‘অগ্নিপথ প্রকল্প’ও প্রত্যাখ্যান করেছে নেপাল।
যাইহোক, এই নিরপেক্ষতার জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। বড় শক্তিগুলো সাহায্য কমিয়েছে, কারণ এর বেশিরভাগই জোটের সদস্যদের জন্য রাখা। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতায় নেপালের প্রবেশ ধীর হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ধীর হওয়ায় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
চীনের কঠোর কোভিড-১৯ নীতিগুলোও সম্পর্কে টানাপোড়ন তৈরি করে। এত মূল অবকাঠামো প্রকল্পগুলো স্থগিত হয়ে যায় এবং পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, নেপালের উপর ভারতের প্রভাব এখনো শক্তিশালী। যার মূলে রয়েছে যৌথ সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা।
বেইজিংয়ের মন গলাতে ব্যস্ত অলিকে অবশ্যই উভয় প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক সাবধানে রক্ষা করতে হবে। ভারতের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের অবকাঠামোগত কূটনীতিকে কাজে লাগানোর জন্য সূক্ষ্ম কৌশল প্রয়োজন।
সাপকোটা মনে করেন, “চীনের দিকে যেন ঝুঁকে না পড়ে সে জন্য ভারত নেপালকে চাপ দিতে পারে। তবে, বর্তমানে চীন-নেপাল সম্পর্কের গভীরতায় এই ধরনের চাপ তেমন কাজে আসবে না। নেপাল-চীন অংশীদারিত্ব এমন একটি স্তরে পৌছে গেছে যেখান থেকে ফিরে আসা আর সহজ হবে না “
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ