আফগানিস্তান আবারও সেই পরিচিত ও বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। দেশটি আবারও প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের মধ্যে আটকে পড়তে যাচ্ছে, যেখানে দেশটির সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বৈধতা দুর্বল হচ্ছে।
ইতিহাস খুব কঠিন সতর্কবার্তা দেয়। শেষবার যখন আফগানিস্তান বিদেশি শক্তির দাবার বোর্ডের ছক হয়ে উঠেছিল, তখন দেশটি কয়েক দশক ধরে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল। গভীর ক্ষত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। আজকের লক্ষণগুলো খুবই পরিচিত। এ লক্ষণগুলো যদি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে ফল হবে ভয়াবহ।
সম্প্রতি আফগান ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলায় হামলা হয়েছে। ঠিক একই সময়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লি সফরে ছিলেন। এ দুটি ঘটনা একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।
কাবুল এখন আর পাকিস্তানের নিরপেক্ষ প্রতিবেশী নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবে আফগানিস্তান এখন বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ইসলামাবাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে ধারণা করা হচ্ছে, এসব হামলা হয়তো ভারতের সমন্বয়ে বা সহযোগিতায় হয়েছে। এসব প্রতিবেদন যে আশঙ্কার সতর্কঘণ্টা বাজাচ্ছে, সেটি হলো আফগানিস্তানকে আবারও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানকে প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিপদ শুধু তত্ত্বগত বিষয় নয়। আশি ও নব্বই দশকে আফগান ভূখণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর শক্তি পরীক্ষার মাঠে পরিণত হয়েছিল। প্রথমবার সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়। দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের অভিযানের সময়। ফল হলো কয়েক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধ, দুর্বল শাসনব্যবস্থা আর একটি অস্থিতিশীল অঞ্চল।
শরণার্থী স্রোত, সশস্ত্র জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও উগ্র মতাদর্শের বিস্তারের প্রতিবর্তী প্রভাব পাকিস্তান, ইরান এবং অন্যান্য জায়গাতেও পড়েছিল। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতে দেওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়াকে তার খেসারত দিতে হয়েছে।
আজও সেই একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আফগান বাহিনী যখন পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলায় হামলা চালাচ্ছে, ঠিক সে সময়ে ভারত স্যার ক্রিক ইস্যু উত্থাপন করছে এবং ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে বাগাড়ম্বর জোরদার করছে।
ভারত ও তালেবানের মধ্যকার এ সমন্বয় এ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দেয় যে আফগানিস্তানকে এমন একটি কৌশলগত পরিস্থিতিতে টেনে নেওয়া হচ্ছে, যেখানে নিজের দেশের জনগণের চেয়ে বিদেশি ক্রীড়নকেরাই লাভবান হবে। কাবুল যদি অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তালেবানের শাসন দুর্বল হবে, নাগরিকদের আস্থা হারাবে। এমন একটি সংঘাতের চক্রের দুয়ার খুলে যাবে, যা কয়েক দশক স্থায়ী হতে পারে।
পাকিস্তানের জন্য ফল এখানে স্পষ্ট। সীমান্তের উসকানি মোকাবিলায় মনোযোগ ও সম্পদ ব্যয় করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা দুর্বল হবে, সামরিক বাহিনী তার প্রস্তুতি নিয়ে চাপের মুখে পড়বে এবং পূর্ব সীমান্তে (ভারত সীমান্তে) প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা হ্রাস পাবে। পাকিস্তানকে যদি দুই সীমান্ত নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, তাহলে সেটা সরাসরি ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দেয়।
পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ করে পাকিস্তান যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব সীমান্ত থেকে আসা চাপের মুখে দেশটি নাজুক অবস্থায় পড়বে। আফগানিস্তানের প্রক্সি ভূমিকা ইসলামাবাদের সামরিক ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলে।
সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে আফগানিস্তানকেই। আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে নিজেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিলে দেশটি তার বৈধতা হারাবে। আন্তর্জাতিক দাতা ও বিনিয়োগকারীরা এমন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দ্বিধা, যারা নিজেদের সার্বভৌমের বদলে বিদেশি রাষ্ট্রের খেলার পুতুল হিসেবে কাজ করে।
আফগানিস্তানে নাগরিকেরা তাদের সরকারের কতটা স্বাধীনতা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। এটি শেষ পর্যন্ত অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ইতিহাস বলে, প্রক্সি হিসেবে ব্যবহৃত জাতি দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য সংগ্রামের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ঝুঁকিও অনেক বেশি। অস্থিতিশীল আফগানিস্তান শুধু নিজ সীমান্তের ভেতরে নয়, পুরো অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলবে। শরণার্থী স্রোত, জঙ্গি নেটওয়ার্ক ও অর্থনৈতিক সংকট পাকিস্তান, ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আঞ্চলিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হবে।
পাকিস্তানকে অবশ্যই পরিষ্কার কৌশলগত স্বচ্ছতার পথ ধরতে হবে। পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিশোধ সংঘাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে বিদেশি ক্রীড়নকদের স্বার্থ সিদ্ধিতে সুবিধা করে দেবে। ইসলামাবাদের উচিত কৌশলগত সংযম প্রদর্শন করা। আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কার্যকর প্রস্তুতি রাখতে হবে।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, আফগানিস্তানকে বারবার অন্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফল দীর্ঘস্থায়ী হয়। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটা শুধু কল্পনা নয়। যদি কাবুল আবারও এমন অবস্থায় পড়ে, তাহলে গোটা অঞ্চল দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্থিতিশীল, সংঘাতপূর্ণ ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।
আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। এগুলো রক্ষা করা শুধু আফগানদের দায়িত্ব নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ারও এক জরুরি দায়িত্ব। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিতে পারলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর তার ভয়াবহ প্রভাব কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।
এশিয়া টাইমস