দিন কয়েক আগে ভারত ও ইসরায়েল একটি ঐতিহাসিক বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তিটির নাম ‘বাইল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’ (বিআইএ)। এর লক্ষ্য হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা আরও সহজ ও স্থিতিশীল করা।
৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেন, এই চুক্তি ভারতীয় ও ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে, ইসরায়েলি রপ্তানি শক্তিশালী করবে এবং দ্রুত বর্ধনশীল বিশ্ববাজারে দুই দেশের ব্যবসার জন্য স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ‘সরঞ্জাম’ দেবে। তিনি আরও যোগ করেন, ভারত একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি এবং এ সহযোগিতা ইসরায়েলের জন্য একটি অসাধারণ সুযোগ।
ভারত সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এটি এমন একটি চুক্তি, যা দীর্ঘ মেয়াদে ভারত ও ইসরায়েলের অর্থনীতিকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত রাখবে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কিছু সরকার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগ করেছে। কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া ইসরায়েলে কয়লা রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘেরাবন্দী ভেঙে দেওয়ার আশা নিয়ে শত শত সাধারণ মানুষ নৌকায় বসে গাজায় সাহায্য, খাদ্য ও ওষুধ পাঠাচ্ছেন।
এসবের মধ্যে দিল্লি যখন ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী স্মোট্রিচকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করল, তখন বুঝতে হবে, এটি কেবল ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের সংকেত নয়; বরং ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেও তার সঙ্গে যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি।
স্মোট্রিচ হলেন এমন একজন নেতা, যাঁকে পাঁচটি পশ্চিমা দেশে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকানির জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়েছে। ইউরোপে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ভারত কার্যত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করতে এগিয়ে এসেছে।
চুক্তির মূল উদ্দেশ্য অর্থ ও বিনিয়োগ সুরক্ষা। তবে এর অন্যতম লক্ষ্য হলো আদানির হাইফা বন্দর-সংক্রান্ত বিনিয়োগ রক্ষা এবং ভারত-মধ্যপ্রাচ্য করিডর (আইএমইসি) বা পশ্চিমা বাজারের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগ বজায় রাখা।
আইএমইসি করিডরটি যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পরিকল্পিত। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরু হওয়ার পর এটি নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছে।
মনে রাখা দরকার, ভারত ও ইসরায়েলের চুক্তি কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি রাজনীতি, কূটনীতি, শক্তি প্রদর্শন ও আস্থার সংকেতও বহন করছে। এটি ভারত, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংহতি গড়ে তোলার একটি মাধ্যম।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজায় আনুমানিক দুই লাখ মানুষকে হত্যা, আহত বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু করেছে। গাজার প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ এখন দুর্ভিক্ষে বসবাস করছেন, যা সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি অবরোধ ও ঘেরাবন্দীর কারণে হয়েছে।
গাজা পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বের মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন।
এটি এক দশক ধরে এবং গণহত্যার সময় ভারতের ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে আবারও প্রমাণ করেছে।
ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কোনো ধীরগতি দেখা যায়নি। ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের কাজের অনুমতি বাতিল হওয়ার পর ভারত সেখানে শ্রমিক পাঠাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করছে এবং নতুন বিনিময় কার্যক্রম চালাচ্ছে। একই সঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ক্রমাগত ইসরায়েলের গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এক দশক ধরে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা ভারত। গাজায় গণহত্যা এই দুই দেশের সম্পর্কের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারেনি। গত দুই বছরে ভারত ও ইসরায়েল পানি, প্রযুক্তি, সাইবার সিকিউরিটি ও কৃষি খাতে চুক্তি করেছে। এসব খাত ইসরায়েল মূলত ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে।
২০২৪ সালে দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্য ছিল প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। আর পরস্পর বিনিয়োগ ছিল আনুমানিক ৮০০ মিলিয়ন ডলার। এ বিনিয়োগের মূল অংশ ছিল সামরিক খাতে। ভারত ইসরায়েলে রত্ন, গয়না, রাসায়নিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য পাঠাচ্ছে। আর তারা ইসরায়েল থেকে অস্ত্র, সার ও যন্ত্রপাতি পাচ্ছে।
ভারত এখন নিজের কারখানায় ইসরায়েলের জন্য অস্ত্র তৈরি করছে। ২০২৩ সাল থেকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইসরায়েলের সামরিক সরবরাহ পূরণের জন্য ড্রোন, রকেট ও বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষের দিকে মিডল ইস্ট আই এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজায় ইসরায়েলের স্থল বাহিনী যে এআইভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা ভারতীয় ও ইসরায়েলি কোম্পানির যৌথ উৎপাদন।
এ সামরিক সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব চুক্তি দেশের জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ভারতের রপ্তানি, বিশেষ করে যেসব সামরিক প্রভাব রাখে, তা দেশের নিরাপত্তা ও চুক্তির দায়বদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত। তিনি আরও বলেছেন, ইসরায়েল ভারতের নিরাপত্তায় বিশ্বাসযোগ্য সহযোগী এবং বিভিন্ন সময় বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সম্পর্কে জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, যেহেতু ভারত আইসিসির সদস্য নয়, তাই তারা আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেবে না।
বিআইএ এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক চুক্তি আরও কার্যকর করে। একই সঙ্গে এটি ভারতের ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও আদর্শগত মিলকেও দৃঢ় করে।
ভারত ও ইসরায়েল উভয়ই তাদের দেশের শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রসারণমূলক নীতি চালাচ্ছে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েল কেবল ইসরায়েলিদের জন্য বসতি স্থাপন করছে, আর কাশ্মীরে ভারত কেবল হিন্দুদের জন্য বসতি গড়ার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া আইনি ব্যবস্থার আড়ালে ইসরায়েলের ল অব রিটার্ন ও নেশন স্টেট ল এবং ভারতের সিএএ নাগরিকত্বকে ধর্মের ওপর নির্ভরশীল করছে।
উভয় দেশের সরকারই নজরদারি ও ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার করছে। বিরোধীদের ওপর স্বেচ্ছাচারিতা চালানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে। কাশ্মীরে ভারত সিসিটিভি, স্থানীয় গুপ্তচর ও সাংবাদিকদের বাড়ি পরিদর্শন ব্যবহার করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে। পাশাপাশি জনগণকে বঞ্চিত করা, ঘর ধ্বংস করা ও ধর্মীয় স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ভারত ও ইসরায়েল উভয়ই এসব কৌশলকে তাদের রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উপায় হিসেবে দেখছে।
এই চুক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্তা দিচ্ছে—ভারত গণহত্যা চালানো কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যা দেখছে না। চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত ইসরায়েলের ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করছে।
মূল: মিডল ইস্ট আই, অনুবাদ: প্রথম আলো