বাংলাদেশকে হুবহু অনুকরণ করেছে নেপালের গণ-অভ্যুত্থান

বাংলাদেশকে হুবহু অনুকরণ করেছে নেপালের গণ-অভ্যুত্থান
বাংলাদেশের হুবহু প্রতিচ্ছবি নেপালে। ছবি: সংগৃহীত

নেপালের সরকার পতনের সঙ্গে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের সরকার পতনের বিস্ময়কর মিল দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন ছোট্ট একটি ইস্যু থেকে তরুণদের আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু হয়েছিল এবং তার জের ধরে নির্বাচিত সরকারের পতন হয়েছিল; নেপালেও তা–ই ঘটল।

কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর সেখানে সেনাপ্রধান কার্যত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। পুরো ঘটনাই যেন ঢাকার ঘটনা পুনরাবৃত্তি। বিশেষ করে পাঁচটি ক্ষেত্রে এই দুই দেশের ঘটনায় আশ্চর্য রকমের মিল পাওয়া যাচ্ছে।

১. তরুণদের নেতৃত্ব

বাংলাদেশের মতো নেপালেও আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জি। কাঠমান্ডু থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এক দিনে ছড়িয়ে পড়ে পোখারা, বিরাটনগর, ভরতপুরসহ ৭৭ জেলার রাজধানীতে। নেপালের ৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ জেন–জি; আর ৯০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তাই আন্দোলন মুহূর্তেই ব্যাপক হয়ে ওঠে।

স্কুল-কলেজের পোশাক পরা হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। ‘যুবসমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ স্লোগান তুলেছিল, যেটি সংগঠিত করেছিল এনজিও ‘হামি নেপাল’। এর নেতৃত্বে ছিলেন ৩৬ বছর বয়সী কর্মী সুদান গুরুং।

এই তরুণেরা ‘নেপো বেবি’ আর ‘নেপো কিডস’-এর বিরুদ্ধে সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের চাকচিক্যময় জীবনযাত্রা নিয়ে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছিল।

বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কারণ, কোটা আওয়ামী লীগের অনুগতদের জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরি করছিল। এখানেও প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিলেও পরে আন্দোলনে মৌলবাদী গোষ্ঠী ঢুকে পড়ে।

দুই দেশেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল তরুণদের মূল হাতিয়ার। বাংলাদেশে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ, আর নেপালে টিকটক (যেটি নিষিদ্ধ হয়নি) ও ভিপিএন আন্দোলন জমাতে ভূমিকা রেখেছিল।

২. ছোট্ট ট্রিগার থেকে বড় বিস্ফোরণ

বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন আর নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ—দুটিই তুলনামূলক ছোট ইস্যু ছিল। কিন্তু এগুলো আড়ালে থাকা দুর্নীতি, বৈষম্য আর অকার্যকর শাসনের ওপর চাপা ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে তোলে।

নেপালে ৪ সেপ্টেম্বর তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন না করা, ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানো, প্রতারণা রোধ ইত্যাদি। কিন্তু জনগণের চোখে এটা ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের চেষ্টা।

টিকটক আগে থেকেই নিবন্ধন করায় নিষিদ্ধ হয়নি। আর সেটিই আন্দোলনকারীদের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে যেমন কোটা নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে ছোট বিষয়টা ছিল আসলে স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির প্রতীক, তেমনি নেপালে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করা ছিল তরুণদের কণ্ঠরোধের প্রতীক।

ফলাফল একই হয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার পতন হযেছে। আর নেপালে মাত্র দুই দিনেই অলি সরকারের পতন হয়েছে।

৩. বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু

বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজারো মানুষ মারা যায়। সরকারি হিসাবে ১ হাজার জন আর পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস জানান, প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন নিহত হয়েছিলেন।

নেপালে প্রথম দিনের সংঘর্ষেই ২০ জন নিহত হন। তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে যেমন বিক্ষোভকারীদের হত্যার পর আন্দোলন তীব্র হয়েছিল, নেপালেও প্রথম দিনের মৃত্যুগুলো দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।

৪. মন্ত্রীদের বাড়ি সরকারি স্থাপনায় হামলা

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার গণভবন, সংসদ ভবন, মন্ত্রীদের বাড়ি, থানা—সব জায়গায় হামলা হয়েছিল।

নেপালেও একই দৃশ্য। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী অলির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। তাঁকে হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক ও বিরোধী দলের নেতা পুষ্প কমল দহলের বাসায় হামলা হয়। অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলকে আন্দোলনকারীরা প্রকাশ্যে মারধর করেন।

দুই দেশেই মন্ত্রীর বাড়ি, সরকারি কার্যালয় ও সংসদে হামলা হয়েছিল। এই আক্রমণগুলো ছিল দুর্নীতি আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিরোধ।

৫. প্রধানমন্ত্রীর পতন আর সেনাবাহিনীর ভূমিকা

বাংলাদেশে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেন। সেনাবাহিনী জানায়, তারা জনগণের পাশে থাকবে, গুলি চালাবে না। ৫ আগস্ট হাসিনাকে হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়তে হয়।

নেপালেও একই ঘটনা। সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল অলিকে বলেন, সেনাবাহিনী স্থিতিশীলতা আনতে পারবে, যদি তিনি পদত্যাগ করেন। ফলে মঙ্গলবার অলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

আসরে বাংলাদেশের কোটাব্যবস্থা আর নেপালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ—দুটিই তরুণদের ক্ষোভ উসকে দিয়েছে। দুই দেশেই আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা, পরে সাধারণ জনগণ তাতে যোগ দেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ দুটি দেশ ভারতের প্রতিবেশী ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই দুই সরকারের পতন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন নির্দেশ করছে।

ইন্ডিয়া টুডে থেকে অনুবাদ প্রথম আলো