এশিয়ার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে মোদির চীন সফর 

এশিয়ার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে মোদির চীন সফর 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) সম্মেলনে অংশ নিতে চীন সফর করছেন। এ সফরের ওপর পুরো বিশ্বের নজর রয়েছে। কারণ, এটি দুই প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে নতুন সহযোগিতামূলক যুগের সূচনা হতে পারে।

ভারত ও চীনের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট মানুষের প্রায় ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ভারত খুব শিগগির তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে।

সম্প্রতি মোদি ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর বৈঠকে দুই পক্ষই একমত হয়েছে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; বরং অংশীদার। তারা মনে করে, এশিয়ার শতক বা ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ আসতে হলে দুই দেশের সহযোগিতা অপরিহার্য।

চীন ও ভারতের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরোনো। কুষাণ সাম্রাজ্য ও হান রাজবংশের সময় থেকে বাণিজ্য শুরু হয়। সিল্ক রোডের মতো প্রাচীন পথ দিয়ে পণ্য, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির আদান–প্রদান হতো। শুধু বাণিজ্যই নয়, ধর্ম ও দর্শনও একে অপরকে সমৃদ্ধ করেছে। বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে চীনে ছড়িয়ে পড়ে, আর চীনা ভিক্ষুরা ভারত ভ্রমণ করে ধর্ম ও জ্ঞান সংগ্রহ করতেন। বিখ্যাত ভিক্ষু জুয়ানজাং সপ্তম শতকে ভারত সফর করে বৌদ্ধ শিক্ষার গভীর জ্ঞান নিয়ে চীনে ফিরেছিলেন।

এ ইতিহাস কেবল ধর্ম নয়, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিকভাবে দুই সমাজকেই সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক যুগে এ সম্পর্ক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও দৃঢ়। ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে অনুষ্ঠিত বান্দুং সম্মেলন এটির উদাহরণ। সেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীন দেশগুলো শান্তি, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে এক হওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেছিল। ভারত ও চীনও অংশ নিয়ে আধুনিক কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে।

ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি। দেশটির সবচেয়ে বড় তরুণ জনগোষ্ঠী, দ্রুত বেড়ে ওঠা উদ্ভাবনব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা বাজার রয়েছে। চীন অবকাঠামো, উৎপাদনশিল্প, ডিজিটাল শাসন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে দক্ষ। দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করলে সম্ভাবনা অসীম।

চীন ভারতের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির ধাপে বিনিয়োগে গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারে। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ভারতের সবচেয়ে বেশি অর্থসহায়তা নেওয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

এআইআইবির মাধ্যমে চীন ও ভারত অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, জনস্বাস্থ্য ও টেকসই কৃষির মতো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। ২৮০ কোটি মানুষের শক্তি কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল সংযোগ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা পর্যন্ত অসংখ্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এটি কোনো এক পক্ষের অপর পক্ষকে সাহায্য করার বিষয় নয়; বরং দুই দেশের পরস্পর পরিপূরক শক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ। বিশ্বের এ দুই জনবহুল দেশ একসঙ্গে এশিয়ার স্থিতি ও সমৃদ্ধির মূল স্তম্ভ হতে পারে।

চীন ও ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক শাসনের ভিত্তি গড়ে দিতে পারে। উভয় দেশই ব্রিকস, জি-২০ এবং এসসিওর কেন্দ্রীয় সদস্য। এ সংগঠনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষমতায়ন করতে পারে এবং বৈশ্বিক বাজার ও প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার একতরফা পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় এ সহযোগিতার প্রয়োজন বিশেষভাবে জরুরি।

উদাহরণস্বরূপ, ভারত যখন রাশিয়া থেকে নির্দিষ্ট দামে তেল কিনেছিল, তখন তা বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়া ঠেকানোর জন্য ওয়াশিংটন উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু এখন একই কারণে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ভালো খবর হলো, চীন ও ভারত একা নয়। ক্রয়ক্ষমতা সমান হিসেবে হিসাব করলে এশিয়া ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-পঞ্চমাংশের বেশি। ভারত যদি আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিতে (আরসিইপি) যোগ দেয়, তাহলে দেশটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোটের অংশ হবে। এতে ভারত অন্যান্য দেশের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে।

আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা খুব দ্রুত এগোবে। চীনের সমর্থন থাকলে ভারত নিজের শর্ত মেনে অংশ নিতে পারবে। আজকের অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ব্যাঘাতের মধ্যে এটি ভারতের জন্য অত্যন্ত লাভজনক ও প্রয়োজনীয়।

১৯৫৫ সালের বান্দুং সম্মেলনের চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক। ওই সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার নেতারা পারস্পরিক সম্মান, নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের ভিত্তিতে সহযোগিতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ওই সম্মেলন থেকেই ‘নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’ বা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের জন্ম।

বান্দুং চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে শুধু যৌথ লক্ষ্য স্থির করাই নয়, বর্তমান চ্যালেঞ্জও বিচক্ষণভাবে মোকাবিলা করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ দ্বিপক্ষীয় আস্থাকে পরীক্ষা করেছে।

মনে রাখতে হবে, ১৯৬০-এর দশকের পর অর্ধশতাব্দী শান্তি বিরাজ করেছিল, যতক্ষণ না গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ ঘটেছিল। দীর্ঘমেয়াদি সহাবস্থানই স্বাভাবিক। আবার সেই মনোভাব গ্রহণ করলে বান্দুংয়ের উত্তরাধিকারকে সম্মান জানানো হবে এবং দুই দেশকে অংশীদারত্বের সম্ভাবনার দিকে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ দেবে। ভারত ও চীন উভয়ই একমত যে মতপার্থক্য বড় বিরোধে রূপ নেবে না। যদি ৫০ বছর শান্তি বজায় থাকতে পারে, তা আবারও সম্ভব।

মোদির এ সফর যৌথ ঘোষণাপত্র বা সহযোগিতার রূপরেখা তৈরির ভালো সুযোগ। সীমান্ত পারাপারের বাস্তব সহযোগিতা, পর্যটন, একাডেমিক প্রোগ্রাম, বিনিয়োগ চুক্তি, অবকাঠামো, সবুজ রূপান্তর, পরিবেশ সুরক্ষা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সমন্বয়—এসব খাতেই উন্নতির বিশাল সুযোগ রয়েছে।

সবুজ উন্নয়ন, বহুপক্ষীয় ও শান্তিকে কেন্দ্র করে গড়া এ দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব রূপ নেবে যখন মোদি এ বছর আবার প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। চীন ও ভারত কেবল প্রাচীন জ্ঞান ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনারও রক্ষক। ড্রাগন আর হাতি একসঙ্গে কাজ করলে তারা এমন এক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারবে, যা শুধু দুই মহান সভ্যতার জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যও আগামী কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদকৃত প্রথম আলো থেকে নেওয়া