ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর ছয় দিন পরেও সংঘাতের তীব্রতা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অভিযানে ইসরাইলের লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পঙ্গু এবং দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা। কিন্তু এই সংঘাত প্রতিবেশী দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। কৌশলগত স্বার্থ এবং সম্পর্কের বিবেচনায় এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত।
ইরান জুড়ে সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। তেহরানের বিভিন্ন স্থাপনা ও কৌশলগত স্থানও হামলার লক্ষবস্তু করা হয়েছে। হামলায় ইরানের সেনাপ্রধানসহ বেশ কয়েকজন জেনারেল এবং পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে।
ইরানি কর্মকর্তারা ইসরায়েলি হামলার উপযুক্ত জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ইরান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ইরানি ক্ষেপনাস্ত্র ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে। এতে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
অনেক কারণে এই সংঘাত ভারতের জন্য বেশ খারাপ খবর।
প্রথমত, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ পথ হিসেবে ইরান কাজ করছে। ইরানের চাবাহার বন্দরে কয়েক বিলিয়ন ডলার ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে। এই বন্দরকে ভারত পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী।
কেবল জ্বালানি নিরাপত্তার দিক থেকে নয়, বরং বিরল খনিজ পদার্থের প্রাচুর্যের কারণেও মধ্য এশিয়া ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ভারতের এই সংযোগ পরিকল্পনাকে বিপন্ন করবে এবং দীর্ঘ প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।
আঞ্চলিক উত্তেজনা আফগানিস্তানের সঙ্গেও ভারতের সংযোগ ছিন্ন করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, চীন দ্রুত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করবে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই চেষ্টা করে আসছে। সাম্প্রতিক চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ত্রিপক্ষীয় সংলাপ ছিল সেই বিষয়ে বেইজিংয়ের প্রচেষ্টার সর্বশেষ উদাহরণ।
ইরানে ইসরায়েলের হামলা ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ভারত আমদানি করা তেলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। দেশটির ৮০ শতাংশেরও বেশি অপরিশোধিত তেল আসে পশ্চিম এশিয়া তথা ইরান ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ থেকে। এই সংঘাতের ফলে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম উর্ধ্বমুখি। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন যে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১২০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এতে ভারতের মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি এবং চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাবে। তেলের উচ্চ মূল্য পরিবহন খরচের উপরও প্রভাব ফেলবে। ফলে পণ্য ও পরিষেবার দাম বৃদ্ধি পাবে। এতে পরিবারের বাজেট সংকুচিত হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর প্রভাব পড়বে।
এই সংঘাত উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ইসরায়েল এবং ইরানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয়ের বাসরে। তাই শত্রুতা বৃদ্ধি তাদের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করতে পারে।
অন্যদিকে, ইরানের উপর ইসরায়েলের হামলা পাকিস্তানের কৌশলগত গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরান দুর্বল হলে তা ভারতের জন্য অনুকূল হবে না, বরং এতে পাকিস্তানের বেশি সুবিধা হবে।
একটি মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের সাথে ইরানের তেমন শক্তিশালী সম্পর্ক ছিল না। বরং, ভারতের জন্য ইরান গুরুত্বপূর্ণ কারণ দুই দেশ এই অঞ্চলে চীন-পাকিস্তান জোটের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করে আসছে।
কাশ্মিরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বল্পস্থায়ী সংঘাত এই অঞ্চলের কৌশলগত সমিকরণ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে ভারত বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। পাকিস্তান এবং ভারতকে সমান স্তরে রাখার মার্কিন নীতিকে ভারত মেনে নিতে পারছে না। নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে, মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা পাকিস্তানকে “ব্যতিক্রমী সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অংশীদার” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হলে ইরানের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত থাকা পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মূল্যবান ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ হয়ে উঠবে। ফলে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি পেতে পারে। এটা ভারতের জন্য সুখকর হবে না।
ইসরায়েল ও ইরান উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘাত নয়াদিল্লিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তারা আর সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করতে চলতে পারছে না। ভারত ইতোমধ্যে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) যৌথ বিবৃতিতে ইসরাইলের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশটিকে ইরান বা ইসরায়েল যে কোন এক পক্ষকে বেছে নিতে হবে।
তখন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেও প্রভাব ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করা ভারতের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ