বাঙ্কার বাস্টার দিয়েও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা যাবে না

বাঙ্কার বাস্টার দিয়েও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা যাবে না
ইরানের একটি পারমাণবিক স্থাপনা। ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থার (আইএইএ) প্রধান সতর্ক করে বলেছেন যে ইরানের সবচেয়ে সংবেদনশীল পারমাণবিক স্থাপনাগুলো মাটির এত গভীরে যে মাত্র একবার বিমান হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা সম্ভব নয়।

তার এই বক্তব্য দেশটির পারমাণবিক শক্তির বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের যেকোনো সামরিক বিকল্পের জটিলতা সম্পর্কে উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থাপনা মাটির আধা মাইল বা প্রায় ৮০০ মিটার গভীরে অবস্থিত। আমি সেখানে অনেকবার গিয়েছি। সেখানে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে সর্পিল সুড়ঙ্গ পথ ধরে অনেক নীচে নামতে হবে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণু আলোচনা চলছে। আলোচনা ভেঙে গেলে এই অঞ্চল একটি বিপর্যয়কর সংঘাতের দিকে অগ্রসর হতে পারে। এমন আশঙ্কার মধ্যে গ্রোসি এই মন্তব্য করলেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরানের বিষয়টি বিপর্যয়কর হয়ে ওঠার অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা রয়েছে। আলোচনায় ব্যর্থ হলে এর মানে হবে সম্ভবত সামরিক পদক্ষেপ।

গ্রোসি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের কাছে এখনও পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তবে তারা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত করেছে, যা বিপজ্জনক সীমার কাছাকাছি চলে যেতে পারে।

আইএইএ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে তারা ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক উপাদানের অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নন। এর মধ্যে অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রাংশও রয়েছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সীমিত আঘাত হানতে পারে। তবে এর জন্য একাধিক অভিযান চালানোর প্রয়োজন হবে। বহুস্তরযুক্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে হবে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে এস-৩০০ এর মতো রাশিয়ার তৈরি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা।

সীমিত পরিসরের অভিযানে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হয়তো ইসরাইল আছে। কিন্তু মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার জন্য এই পদ্ধতি অপারেশনাল ঝুঁকি এবং জটিলতা অনেক বাড়াবে।

ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুটি শক্তিশালী স্থাপনা: নাতানজ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যা প্রায় তিন তলা ভবনের সমান মাটির গভীরে অবস্থিত এবং ফোরদো স্থাপনা, যার অবস্থান পাহাড়ের অনেক গভীরে। দুটি স্থাপনাই এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন বিমান হামলা চালিয়ে এগুলোর কোন ক্ষতি করা না যায়।

ইসরাইলের হাতে ৫,০০০ পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার বোমা থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন যে টেকসই এবং সমন্বিত বিমান হামলা ছাড়া মাটির অনেক গভীরে থাকা ফারদো স্থাপনার কোন ক্ষতি করা যাবে না।

এ ধরনের স্থাপনার জন্য সত্যিকারের হুমকি সৃষ্টি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকা ১৪,০০০ কেজি ওজনের ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ (এমওপি)। এগুলো বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানে মোতায়েন করা আছে। ভারত মহাসাগরের ডিয়েগো গার্সিয়া ঘাঁটিতে সম্প্রতি এ ধরনের বি-২ বিমান মোতায়েনের খবর পাওয়া গেছে। এগুলো ইরানের জন্য সত্যিকারের হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

মার্কিন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল চার্লস ওয়াল্ড বলেন, ইসরাইলের কাছে পর্যাপ্ত বাঙ্কার বাস্টার নেই। তাই ইসরাইলের যেকোনো একক পদক্ষেপ ধীর, জটিল এবং অনেক কম কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে মার্কিন-ইসরাইলি যৌথ অভিযানের সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

এতেও ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। বড়জোর কিছুটা ধীর করা যাবে বলে তিনি মনে করেন।

পারমাণবিক বিশ্লেষকরাও সতর্ক করে দিয়েছেন যে এমনকি শক্তিশালী হামলা চালিয়েও ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনকে কেবল পিছিয়ে দেয়া যাবে, ধ্বংস করা যাবে না।

তাদের মতে, সামরিক শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির পিছনে যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা দেশীয় শিল্প ভিত্তি রয়েছে তা মুছে ফেলা যাবে না। এ ধরনের যেকোনো হামলার কৌশলগত প্রভাবও হবে সুদূরপ্রসারী।

হামলার কারণে তেহরান সম্ভবত আইএইএ পরিদর্শকদের বহিষ্কার করবে এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক তত্ত্বাবধান সংস্থাগুলোর সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে। এতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবে।

এই ধরনের পদক্ষেপের ফল উত্তর কোরিয়া মতো হতে পারে। তারা আইএইএ পরিদর্শকদের বহিষ্কার করার পরে সফলভাবে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জেমস অ্যাক্টন সতর্ক করে বলেন, আপনি যদি ইরানে বোমাবর্ষণ করেন, তাহলে ইরান প্রায় নিশ্চিতভাবেই আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের বহিষ্কার করবে, বোমার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

মধ্যপ্রাচ্য যখন গাজা ও লেবানন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পর্যন্ত বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত, তখন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা নিয়ে যেকোনো উত্তেজনা আরও বিস্তৃত আঞ্চলে উত্তেজনার সূত্রপাত করতে পারে।

এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছকে যেকোনো ভুল হিসাব পুরো অঞ্চলকে একটি সুক্ষ্ম প্রতিরোধ ভারসাম্য থেকে পুরোদস্তুর সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।