বাংলাদেশের নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকারের সাথে সতর্কতার সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে ভারত। ২০২৪ সালের আগস্টে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে একরকম এড়িয়ে চলেছেন। তাদের একমাত্র আলাপচারিতা হয় এপ্রিলের শুরুতে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত সমর্থন জানালেও পর্দার আড়ালে ভারতীয় কর্মকর্তারা তেমন খুশি হতে পারছেন না। তাই মোদী-ইউনূস বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশি পক্ষের বক্তব্যকে “দুষ্টু” এবং “রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” হিসেবে অভিহিত করে তারা মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে দিয়েছেন।
এই কূটনৈতিক শীতলতা গভীর অনিশ্চয়তার প্রতিফলন নির্দেশ করছে। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তাকে দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় নয়াদিল্লির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে দেখা হত। ভারতের সাথে হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক একটি সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক গতিশীলতা তৈরি করে। এখন ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিভঙ্গি এমনভাবে প্রসারিত করছে যা ভারতের প্রায় একচেটিয়া প্রভাবকে খর্ব করেছে।
ইউনূসের বেইজিং সফর এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি আঞ্চলিক উন্নয়নে চীনের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন এবং বাংলাদেশকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর “সামুদ্রিক অভিভাবক” হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি অর্থনৈতিক বিবেচনায় এই বক্তব্য দিলেও বার্তাটির কৌশলগত গুরুত্ব স্পষ্ট। প্রতিক্রিয়ায় চীন উৎসাহের সাথে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং দুই দেশ অবকাঠামো, আন্তঃসীমান্ত নদীর তথ্য ভাগাভাগি এবং এমনকি সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে।
ঢাকার নতুন অবস্থান পুরোপুরি বেইজিংয়ের কক্ষপথে প্রবেশ বললে ভুল হবে। বরং এটি কোনও একটি শক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়ানোর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ভারত এবং পশ্চিমাদের মতো নানা রাজনৈতিক শর্ত সংযুক্ত না করেই চীন অবকাঠামোগত চুক্তিকে উৎসাহিত করে। এটা বাইরের হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে দ্রুত স্থিতিশীল হওয়ার চেষ্টারত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য চীনকে একটি আকর্ষণীয় অংশীদার করে তুলেছে।
যদিও এই ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ একেবারে চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিবর্তন ভারতের জন্য কৌশলগত এবং অভ্যন্তরীণ দুই দিক দিয়েই উদ্বেগ তৈরি করেছে। হাসিনার শাসনামলে উপভোগ করা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হারিয়ে ফেলায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতের অবস্থান দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে। এর ফলে নয়াদিল্লির ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশেও ভারত ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে। অমীমাংসিত পানিবণ্টন সমস্যা, সীমান্ত হত্যা এবং দাদাগিরি করা হচ্ছে বলে ধারণার কারণে বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় ভিসা বন্ধের নীতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যা উভয় দেশের নাগরিকদের মধ্যে ভ্রমণ এবং যোগাযোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে এই বাধাগুলো জনসাধারণের সাথে জনগণের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে ভারত সম্প্রতি তার ভূখণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের এই সিদ্ধান্তকে চীনে ইউনূসের মন্তব্যের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে “স্থলবেষ্টিত” এবং প্রবেশাধিকারের জন্য বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তারা এই মন্তব্যকে উস্কানিমূলক এবং অসংবেদনশীল বলে মনে করেন।
সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হলে ভারতকে তার আচরণ ও কৌশল উভয়ই পরিবর্তন করতে হবে। প্রভাব বিস্তারের বদলে ভারত নিজেকে একটি সম্মানজনক এবং গঠনমূলক অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে পারে। এর অর্থ হতে পারে পানিবণ্টন সংক্রান্ত মতবিরোধের সমাধান, যৌথ অবকাঠামো প্রকল্পের পরিধি বাড়ানো এবং তৃণমূল পর্যায়ে আস্থা পুনর্নির্মাণের জন্য ভিসা বিধিনিষেধ শিথিল করা, ইত্যাদি।
বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলনে মোদী-ইউনুসের সংক্ষিপ্ত বৈঠক হতে পারে অনানুষ্ঠানিক। কিন্তু এটি কূটনীতির জন্য একটি দরজা খুলে দিয়েছে। নম্রতা এবং নমনীয়তার সাথে এই সুযোগ গ্রহণ করে ভারত বাংলাদেশকে আরও চীনের আলিঙ্গনে ঠেলে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।
একই সাথে, বাংলাদেশকেও সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে। চীন বড় অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে পারে কিন্তু সেখানেও ঝুঁকি আছে। চীনা মূলধনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নির্ভরতা তৈরি করতে পারে এবং গভীর সামরিক সম্পর্ক বাংলাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানকে বিচ্যুত করতে পারে।
আরেকটি বিষয় হল বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন, যা ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তা বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্র নীতির দিকনির্দেশনা বজায় রাখতে সক্ষম একটি আরও স্থিতিশীল এবং বৈধ সরকার গঠন করতে পারে। একটি অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা বৃদ্ধি করবে। তারা বুঝবে যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক অভিনেতা হিসেবে বাংলাদেশকে উপক্ষা করার সুযোগ নেই।
ঢাকায় যা ঘটছে তা কোন পক্ষ নির্বাচনের বিষয় নয় – এটি নতুন বিকল্প তৈরির বিষয়। বাংলাদেশ অতীতের অংশীদারিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি বরং জটিল ও পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নিজের অবস্থান জোরদার করছে। এই পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী কাজ করাই হলো ভারত, চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বৃহত্তর খেলায় কোন গুটি হিসেবে নয় বরং নিজেকে একজন কৌশলগত খেলোয়াড় হিসেবে দেখাতে চায় বাংলাদেশ। এর অর্থ হল তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তার অগ্রাধিকারগুলোর প্রতি আরও ঘনিষ্ঠ মনযোগ দাবি করছে দেশটি। তাই ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা ও কানেকটিভিটির প্রতি মনোযোগী দেশগুলোর জন্য, তার সার্বভৌমত্ব এবং ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে এমন শর্তে ঢাকার সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করার এখনই সুযোগ।
দ্য ইন্টারপ্রেটার থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ