বিগত দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। যার মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদের উত্থান এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের মাধ্যমে তার শাসনের পতন উল্লেখযোগ্য। এই সময়কালে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে, যাকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে হাসিনার আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে সক্ষম একমাত্র দল বলে মনে করা হয়।
তবে জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও হাসিনার নির্বাচন কারচুপির কারণে বিএনপি বার বার দেশ শাসন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপি কেবল বিএনপিকেই ক্ষমতার বাইরে রাখেনি বরং বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, যেখানে ভিন্নমতকে গুঁড়িয়ে দেয়া এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
২০২৪ সালের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, যা শেষ পর্যন্ত হাসিনার শাসনের পতন ঘটায়, বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এটি গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদের আশা পুনরুজ্জীবিত করেছে। এই ঐতিহাসিক উত্থানের পর বিএনপি নিজেকে এক সন্ধিক্ষণে দেখতে পাচ্ছে। ঐতিহাসিক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, সাংগঠনিক দুর্বলতা, বাইরের চাপ এবং জনসাধারণের প্রত্যাশার পরিবর্তনের কারণে দলটির পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছে। বিএনপি যদি নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে দলটিকে অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে এবং বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
বিএনপির গণভিত্তি এবং কর্তৃত্ববাদের ছায়া
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর একটি হলো বিএনপি। যার গণসমর্থণের ভিত্তি দীর্ঘদিন ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে একই। সাম্প্রতিক কিছু জরিপ বলছে, দলটির প্রতি প্রায় ৪২ শতাংশ ভোটারের সমর্থন রয়েছে। এই স্তরের সমর্থন ইঙ্গিত দেয় যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সম্ভবত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারত। তবে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে এমন পরিবেশ স্পষ্টতই অনুপস্থিত।
হাসিনার নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার ধরে রাখার জন্য সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি দমন-পীড়নের শিকার হয়। এর নেতাদের জেলে পাঠানো হয়, কর্মীদের উপর অবর্ণনীয় জুলুম চলে। এতে দলটির সরকারবিরোধী আন্দোলন চালানোর ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। শেখ হাসিনার নির্বাচন জালিয়াতি কৌশল বিএনপিকে কেবল দেশ শাসনের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করেনি বরং বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদকেও প্রতিষ্ঠিত করে, যেখানে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ বা ভিন্নমতের তেমন কোন সুযোগ ছিল না।
ছাত্র ও যুবকদের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের বিপ্লব ছিল এই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সরাসরি প্রতিক্রিয়া। এটি ছিল হাসিনা সরকারের অপশাসনের প্রতি জনরোষ এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের দাবির একটি শক্তিশালী প্রকাশ। এই বিপ্লব হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হলেও এটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার এক নতুন যুগের সূচনাও করে।
বিএনপির সামনে এটি সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই হাজির করে। একদিকে, ঐতিহাসিক সমর্থনভিত্তি দলটিকে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নেতৃত্বের জন্য স্বাভাবিক প্রতিযোগী হিসেবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এই সমর্থনভিত্তিকে পুঁজি করতে দলের অক্ষমতা তার প্রাসঙ্গিকতা এবং কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে।
তারেক রহমানের অনুপস্থিতি: নেতৃত্বের শূন্যতা
বিএনপির সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হল এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দীর্ঘ অনুপস্থিতি। তিনি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। হাসিনা সরকারের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বেশ কয়েকটি মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই আশা করেছিলেন যে বিপ্লবের পর তিনি দেশে ফিরে আসবেন, কিন্তু তিনি এখনও আসেননি, যদিও তার বিরুদ্ধে প্রায় সব অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে।
তারেক রহমানের অনুপস্থিতি বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছে, যা তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী (জেআই) দক্ষতার সাথে কাজে লাগাচ্ছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় প্রান্তিক শক্তি হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সমর্থন নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ১০ শতাংশেরও কম থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রক্ষণশীল ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তার এই উত্থানের জন্য আংশিকভাবে হলেও বিএনপির কার্যকর বিকল্প হিসেবে জামায়াতের নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতাকে কৃতিত্ব দেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপির সমর্থন ভিত্তি ৪২ শতাংশে স্থির রয়ে গেছে। এতে মনে হয় যে দলটি তার জনসমর্থন বাড়াতে বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তারেক রহমানের অনুপস্থিতি কেবল একটি প্রতীকী বিষয় নয়; বিএনপির শাসন ও নেতৃত্বের ক্ষমতার উপর এর বাস্তব প্রভাব রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান দলের কার্যত নেতা এবং তিনি দেশে ফিরে না আসায় বিএনপি কোন একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। এটি দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে আলোচনার ক্ষমতাকে দুর্বল করছে। বিএনপি তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে চাইলে তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে হবে এবং এই সঙ্কটের সময়ে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ এবং জনগণের আস্থায় ধস
বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসের আরেকটি কারণ হল যে দলটি চাঁদাবাজিতে জর্জরিত, এমন ধারণা। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে, যা দলের সুনাম এবং জনগণের আস্থা নষ্ট করছে। বিএনপি অভিযুক্ত কিছু সদস্যকে বহিষ্কার করে এই সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিলেও এতে দলের ভাবমূর্তির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।
বিপ্লবের তরুণরা যখন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অতীতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছে, তখন ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গতিশীল নেতৃত্ব শৈলী গ্রহণে বিএনপির ব্যর্থতা এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে যে দলটি জনগণের আকাঙ্ক্ষা আমলে নিতে পারছে না।
আমূল পরিবর্তন নাকি রক্ষণশীলতা
বিপ্লব-পরবর্তী যুগে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি বিএনপির রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি একটি দায় হয়ে উঠেছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং কর্তৃত্ববাদের মূল কারণগুলো মোকাবেলা করার জন্য ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকির কারণে আমূল সংস্কার অনুমোদনে বিএনপির অনীহা বোধগম্য। যদিও এটি দলকে যুব-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের দাবির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
জুলাই বিপ্লব তরুণ বাংলাদেশীদের একটি প্রজন্মকে জাগিয়ে তুলেছে যারা রূপান্তরমূলক পরিবর্তন চায়। তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার চায়, ক্রমবর্ধমান সমন্বয় নয়। বিএনপির রক্ষণশীলতা অতীতে একটি কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল থাকলেও এখন অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলকে যদি প্রাসঙ্গিক থাকতে হয়, তাহলে তাদের সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গিকে তরুণদের বিপ্লবী উৎসাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এগিয়ে যাওয়ার পথ: নেতৃত্ব, সংস্কার এবং অন্তর্ভুক্তি
বিএনপির সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু সেগুলো অপ্রতিরোধ্য নয়। নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে দলকে বিভিন্ন ফ্রন্টে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, তারেক রহমানকে দেশে ফিরে আসতে হবে এবং দলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তার উপস্থিতি কেবল বিএনপির সমর্থনকে শক্তিশালী করবে না বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি দলের অঙ্গীকারেরও প্রমাণ দেবে।
দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে চাঁদাবাজি এবং দখলদারিত্বের অভিযোগগুলো সমাধান করতে হবে, যা তাদের সুনাম নষ্ট করেছে। এর জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা এবং কঠোর জবাবদিহিতা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের প্রয়োজন। দলকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গতিশীল নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে, যা তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
পরিশেষে, বিএনপিকে তার রক্ষণশীল মনোভাব এবং আমূল সংস্কারের দাবির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পরিহার করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে দলটিকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে স্থিতাবস্থা মোটেই টেকসই নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অন্যান্য অংশীদারদের সাথে গঠনমূলক সংলাপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি একটি সংস্কারমূলক এজেন্ডা গঠনে সহায়তা করতে পারে, যা হবে একাধারে রূপান্তরকারী এবং টেকসই।
আদর্শিক অন্তর্ভুক্তি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অন্যতম শক্তি, যা বৃহত্তর জোট গঠন এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা উচিত। বিপ্লবের চেতনা ছিল আশা এবং সংহতি। বাংলাদেশকে একটি উজ্জ্বল, আরও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হলে বিএনপিকে এই মূল্যবোধগুলো ধারণ করতে হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ