জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, এর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার

জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, এর ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত টালমাটাল রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সামরিক বাহিনী ছিল একটি কেন্দ্রীয় শক্তি। এটি ছিল অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, গুপ্তহত্যা ও প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের যুগ। তবে, ১৯৯০ এর দশক থেকে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রকাশ্য ভূমিকা মূলত দুটি কারণে কমে আসে: জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ এবং বেসামরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার মাধ্যমে এর অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা। এগুলো রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করার মানসিকতা পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সময় এর সংযত আচরণে।

বাংলাদেশের জন্মের প্রথম দিকে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে সামরিক বাহিনী একটি শক্তিশালী এ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি সন্ধিক্ষণ, যাকে দেশের প্রথম সফল সামরিক অভ্যুত্থান বলা যায়। একই বছরের নভেম্বরে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। তার শাসনকাল মাত্র চার দিন স্থায়ী হয়। তিনি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুগত সৈন্যদের নেতৃত্বে আরেক পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং নিহত হন। জিয়াউর রহমান সেই সময়ে গৃহবন্দী ছিলেন।

সামরিক শাসক হিসেবে জিয়ার ক্ষমতায় উত্থান কিছুদিনের জন্য দেশে সামরিক আধিপত্যের মঞ্চ তৈরি করে। ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের দ্বারা এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড সেনাবাহিনীর মধ্যে গভীর উপদলীয় কোন্দল প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। তখন সেনা অফিসাররা দেশের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছিলেন। ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ফলে সামরিক শাসন আরো প্রলম্বিত হয়।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এরশাদের শাসনামল ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক আধিপত্যের চূড়ান্ত রূপ। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনপ্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অবশেষে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে।

১৯৮৮ সালটি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তখন থেকে তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অবদান রাখতে শুরু করে। তাদের প্রথম মোতায়েন ছিল ইরান ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কাজে, যা বৈশ্বিক শান্তিরক্ষার জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি রক্ষার সূচনার করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা বিশ্বব্যাপী মিশনে নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আবির্ভুত হয়। এসময় সারা বিশ্বে ১০টি মিশনে দেশটির ৭,২৪৬ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। বর্তমানে এটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস।

জাতিসংঘের মিশনে অংশগ্রহণ কেবল সামরিক বাহিনীর পেশাদার মানকে শক্তিশালী করেনি বরং উল্লেখযোগ্য আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাও নিয়ে আসে। মিশনগুলো প্রত্যেক সৈনিকের জন্য ভালো আয় ও আন্তর্জাতিক সুনাম বয়ে আনে। সেনাবাহিনীর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

আর্থিক এবং পেশাগত লাভ ছাড়াও শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সামরিক অগ্রাধিকারকে মৌলিকভাবে বদলে করেছে। জাতিসংঘ মিশনে ধারাবাহিকভাবে জড়িত থাকার ফলে প্রভাব বা সম্পদের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির আগ্রহ কমে যায়। পরিবর্তে, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতিসংঘের নীল পতাকার অধীনে তার ভূমিকার মধ্যে প্রতিপত্তি এবং স্থিতিশীলতার সন্ধান পায়। ফলে তারা দেশে ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ের পরিবর্তে পেশাদারিত্ব ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রতি মনযোগ দেয়।

এই রূপান্তর পূর্ববর্তী দশকগুলোর প্রবণতা বিদায়ের ইংগিত, যখন সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল। অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সশস্ত্র বাহিনীকে একটি নতুন পরিচয় দিয়েছে। একদিকে তারা আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রাখছে, অন্যদিকে দেশীয় রাজনীতির কোন্দল ও দলবাজিতে নিজেদেরকে জড়াচ্ছে না।

সরকার একই সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামরিক বাহিনীকে একীভূত করেছে। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত, সেনা পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা এবং প্রকল্প তাদের জন্য অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। রাজনীতিতে প্রকাশ্য আধিপত্য বিস্তার না করেও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)- এর মতো সংস্থাগুলো সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনে কিছুটা প্রভাব বজায় রাখার সুযোগ দেয়। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় ভূমিকা এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সুবিধা – এই দ্বৈত প্রণোদনা স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এড়িয়ে চলতে সামরিক বাহিনীর জন্য একটি কায়েমী স্বার্থ তৈরি করেছে।

২০০৭-২০০৮ সালে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর সংক্ষিপ্ত হস্তক্ষেপ ছিল এর ক্রমবর্ধমান ভূমিকার প্রতিফলন। তখন সামরিক বাহিনী সরাসরি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেনি তবে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সময় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সহায়তা করেছিল। এই হস্তক্ষেপের পেছনে অভ্যন্তরীণ কারণ এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি – দুটিই ছিল। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর উপর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। এই হস্তক্ষেপ শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসা এবং স্বৈরশাসনের পথে চালিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সময় হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ জোরদার হলে হস্তক্ষেপ করার জন্য সামরিক বাহিনীর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। সামরিক বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মোতায়েন করা হলেও, এর আচরণ ছিল সংযত। সামরিক বাহিনী প্রাথমিকভাবে খুব সীমিত শক্তি প্রয়োগ তবে। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেও সরে আসে। মনে হয় এর পেছনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার সুযোগ হারানো ভয় একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিপত্তি বজায় রাখা ও ব্যক্তিগত আর্থিক সুবিধা হাসিল – উভয়ের জন্যই সুযোগটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের নেতৃত্ব। সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান সত্ত্বেও ক্ষমতা দখল থেকে তিনি বিরত থাকেন। তার এই সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থির এবং অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর একটি দেশে সামরিক শাসনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির স্বীকৃতি। তিনি পূর্ববর্তী নেতাদের মতো হতে চাননি, যারা অভ্যুত্থানকে ক্ষমতা জাহিরের উপায় হিসাবে দেখতেন। তিনি স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক লাভের চেয়ে সামরিক বাহিনীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

তাই বলা যায়, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকার এই বিবর্তন – একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক অভিনেতা থেকে পেশাদার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিষ্ঠানে প্ররিণত হওয়ার বিষয়টি এর ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে নিহিত। যা, অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান; মুজিব, জিয়া, মঞ্জুর এবং মোশাররফের হত্যাকাণ্ড – নিজেদের মধ্যে দলাদলি এবং প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের বিপদ তুলে ধরে। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে শান্তিরক্ষা মিশন ও অর্থনৈতিক সুযোগের মিশেল মূলত সামরিক বাহিনীর অগ্রাধিকারগুলোকে মৌলিকভাবে পুনর্নির্মাণ করেছে।

আজও সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে রয়ে গেছে। তবে এর ভূমিকা রাজনৈতিক আধিপত্যের চেয়ে অর্থনৈতিক এবং পেশাগত স্বার্থ দ্বারা বেশি চালিত হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের সময় এই রূপান্তর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর সংযম নিছক ব্যক্তিগত নেতৃত্বের বিষয় নয় বরং বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা এবং দেশীয় অর্থনৈতিক সংযুক্তি – এই দ্বৈত প্রণোদনা এমন একটি কাঠামো তৈরি করেছে যা সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে নিরুৎসাহিত করে এবং সামরিক বাহিনী একটি পেশাদার ও বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সীমানার মধ্যে কাজ করবে এটা নিশ্চিত করে।

এই উত্তরাধিকার, যদিও চ্যালেঞ্জ মুক্ত নয়, অভ্যুত্থান এবং হত্যাকাণ্ডের অশান্ত যুগ পেছনে ফেলে আসার ইংগিত দেয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের শাসন ও উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে।

দ্য ডিপ্লোম্যাট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ