দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির মানচিত্র নতুন করে আঁকছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির মানচিত্র নতুন করে আঁকছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান
গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন বাংলাদেশের ডি ফ্যাক্টো নেতা মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের জন্য ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কটি পুনরুজ্জীবিত করার চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে।

ইসলামাবাদ এবং ঢাকার মধ্যে বিরল ও উষ্ণ পরিবেশ সৃষ্টির আবহে দুই নেতা কয়েক মাসের ব্যবধানে দুবার সাক্ষাত করেছেন, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঢেলে সাজানোর পথ খুলে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়তে বাধ্য।

পাকিস্তানি যাত্রীদের যাচাই-বাছাই করার জন্য বাংলাদেশ বিমানবন্দরে যে বিশেষ নিরাপত্তা ডেস্ক ছিল ইতোমধ্যে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে, পাকিস্তান থেকে আসা কাউকে আর শারীরিক তল্লাশির সম্মুখিন হতে হচ্ছে না। আর, পাকিস্তান থেকে কার্গো জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে নোঙ্গর করছে। এসব পদক্ষেপ বলে দেয় সম্পর্ক দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে।

পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ একসময় একটি দেশ ছিল। ১৯৭১ সালে এক নৃশংস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা আলাদা হয়ে যায়। তখন থেকে পাকিস্তানের চির শত্রু প্রভারতের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশ।

পাকিস্তান ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ক্ষত এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ঘিরে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি দীর্ঘকাল ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই উত্তরাধিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে জটিলতা যুক্ত করে। সেই ইতিহাস নি:সন্দেহে শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।

ইসলামাবাদের সাথে হাসিনার সম্পর্ক ছিল খুবই তিক্ত। হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের কথিত অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যা পাকিস্তানে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এই বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন অনেকে। ২০১৬ সালে দেশ দুটি পরস্পরের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে। এতে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়।

১৯ ডিসেম্বর মিশরের কায়রোতে ডি-৮ সম্মেলনের সাইডলাইনে শরীফ এবং ইউনূস কথা বলেন। এটা ছিল চার মাসের মধ্যে তাদের দ্বিতীয় সাক্ষাত। প্রথম সাক্ষাতটি হয়েছিল সেপ্টেম্বরে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে।

কায়রোতে তারা দুই দেশের মধ্যে ঘন ঘন উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ হচ্ছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

শরীফ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, বিশেষ করে বাণিজ্য, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় জোরদার করার প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করেন।

শরীফ অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন সুযোগের কথা উল্লেখ করে বলেন যে রাসায়নিক, সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, সার্জিক্যাল সরঞ্জাম, চামড়াজাত পণ্য এবং আইটি সেক্টরে সহযোগিতার বিপুল সুযোগ রয়েছে।

তবে ইউনূস ঢাকার সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ১৯৭১ সালের ইস্যুগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য শরীফকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

তিনি শরীফকে বলেন, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যে ইস্যুগুলো বারবার হাজির হচ্ছে আসুন সেগুলো সমাধা করি। ইউনূস বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সব কিছুর চিরতরে সমাধান করা ভালো হবে।”

১৯৯৬ সালে ক্ষমতা এসে হাসিনা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় “গণহত্যার” জন্য ইসলামাবকে ক্ষমা চাইতে বলেন। এর আগে ঢাকা কখনো এ দাবি করেনি।

জবাবে, ২০০২ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সফরকালে  সাবেক সেনা শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোকে “দুঃখজনক” বলে বর্ণনা করে।

মিশর থেকে ইসলামাবাদে ফিরে শরীফ তার মন্ত্রিসভাকে বলেন যে তার দেশ কায়রোতে ইতিবাচক আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

তিনি আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একটি উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানান। এটা হবে এক বিরল সফর যা দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশের সম্পর্কের গতিশীলতাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

ইসলামাবাদ এবং ঢাকা কাছাকাছি আসার সাথে সাথে মনে হচ্ছে হাসিনার পতনে ভারত হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বড় পরাজিত সৈনিক। বাংলাদেশের সঙ্গে এক সময়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শীলত হয়েউল্লেখযোগ্যভাবে শত্রুতায় রূপ নিচ্ছে।

হাসিনা তার পুরো মেয়াদে ভারতের সাথে বহুমুখী সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এর মধ্যে ছিল প্রত্যন্ত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারত যাতে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে সে বিষয়ে চুক্তি।

উপরন্তু, বাংলাদেশ তিস্তা নদী প্রকল্প মূল্যায়ন করার জন্য বিশেষজ্ঞ পাঠাতে ভারতের অনুরোধে রাজি হয়। এই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

সহিংস গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হাসিনা পালিয়ে  নয়াদিল্লিতে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করার জন্য হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।

ভারত অনুরোধ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে নিরাপত্তার কারণে হাসিনা ভারতে রয়েছে বলে উল্লেখ করলেও বিস্তারিত আর কিছু জানায়নি।

হাসিনার বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ শুরু হয় তখন তিনি চীনে ছিলেন। বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার গভীর ও বিস্তৃত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের ৭২% চীন সরবরাহ করে।

“ফোর্সেস গোল ২০২৩” এর আওতায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে যে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া চলছে তাতে চীন থেকে অস্ত্র আমদানির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

হাসিনা চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করলেও ভারতকে নাখোশ করার ব্যাপারে সর্তক ছিলেন।  তিনি দুই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একটি কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতেন।

ইউনূসের আমলে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার পর বেইজিং দ্রুততার সঙ্গে  ইউনূসকে স্বাগত জানায়।

সেপ্টেম্বরে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বেইজিংয়ের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ইয়াও বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের অঙ্গীকার অপরিবর্তিত থাকবে।

বৈঠককালে, ইউনূস ও শরীফ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে এই বহুপাক্ষিক ফোরামের শীর্ষ সম্মেলন হয়নি।

শেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল নেপালে। পরের সম্মেলনটি ২০১৬ সালে পাকিস্তানে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তখন ভারতের প্রচারণায় বাংলাদেশ, ভুটান এবং আফগানিস্তান অংশগ্রহণ নিতে রাজি হয়নি। সে কারণে শীর্ষ সম্মেলন বাতিল করা হয়েছিল।

ইউনূস বলেন, “আমি সার্কের একজন বড় ভক্ত। আমি এ ইস্যুতে কথা বলে যাব। আমি চাই সার্ক সম্মেলন হোক। এমনকি শুধুমাত্র একটি ফটো সেশনের জন্য হলেও। কারণ এটি একটি শক্তিশালী বার্তা দেবে।”

এশিয়া টাইমস, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ