৮০ দিনে ৮০০ রোগী

৮০ দিনে ৮০০ রোগী
মালদ্বীপের থড্ডো হেলথ সেন্টার (ইনসেটে কলিগদের সঙ্গে সর্বডানে ডা. আহমেদ জুবায়ের)। ছবি: ফেসবুক

মালদ্বীপের মিনিস্ট্রি অব হেলথে জয়েন করার পর ৮০ দিনে রোগী দেখছি ৮০০ জন।

এভারেজ দিনে দশ থেকে ১৫ জন রোগী দেখতে হয় আমাকে।একদিন সর্বোচ্চ ২৫ জন রোগী দেখা লাগছে আমার।

৮ ঘন্টার শিফটে এক ঘন্টা লাঞ্চ বা ডিনার ব্রেক,আধা ঘন্টা কফি/টি ব্রেক।তারমানে ৮ ঘন্টার শিফটে আমি কাজ করি সাড়ে ৬ ঘন্টা।

সাড়ে ৬ ঘন্টায় যদি দশ জন রোগী দেখা লাগে তাহলে প্রতি রোগীকে আমি ৩৯ মিনিট সময় দিতে পারি।

আধা ঘন্টা খুব ইজিলি দেওয়া যায়।

কোন রোগী দেখা নিয়ে আমার তাড়াহুড়া করতে হয়না।

ধীরেসুস্থে রোগীর সব কথা শুনে,ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন সেরে তারপর চিকিৎসা দেওয়ার পর্যাপ্ত সময় মিলে।

আমি এখন যেই হেলথ সেন্টারে পারমানেন্ট পোস্টিং পেয়ে কাজ করছি,সেখানে আমরা দুইজন ডাক্তার পোস্টেড।

আজকের এই মুহুর্ত অব্দি দুইজনে রোগী দেখছি মোট ২৭ জন।আমি ১২ জন দেখছি পুরো ইভেনিং শিফটে,মর্নিং শিফটে আমার কলিগ ১৫ জন দেখে গেছে।

এখন বলুন কোন রোগী কিভাবে অভিযোগ দিবে যে,ডাক্তার সময় দেয়না?ডাক্তার কথা শুনেনা এটা বলার সুযোগ কি আছে?

আমি এখানে মাসে যেই স্যালারি পাই,সেটা বাংলাদেশের একজন ৯ম গ্রেডের বিসিএস চিকিৎসকের ৭ মাসের বেতনের সমান।

বাংলাদেশে উপজেলা গুলোতে একজন চিকিৎসককে সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে একশো রোগী দেখা লাগে।

একশো রোগীর কথা শুনা, হিস্ট্রি নেওয়া,এক্সামিনেশন করা, টেস্ট রিপোর্ট ইভালুয়েট করা,চিকিৎসা দেওয়া,এডভাইজ দেওয়া, কাউন্সেলিং করা কিভাবে সম্ভব এই সময়ের মধ্যে?

একশো প্রেসক্রিপশন হাতে লিখতে কত সময় লাগা উচিত বলে মনে করেন আপনারা?

তাছাড়া সাপোর্টিভ কয়জন স্টাফ থাকে একজন ডাক্তারের জন্য?

আমার বাংলাদেশের একজন কলিগ আমার চেয়ে দশ গুন বেশি রোগী দেখে আমার বেতনের ৭ ভাগের এক ভাগ স্যালারি পায়, তখন সে আপনাকে কতটা সেবা দিতে সক্ষম হবে ভেবে দেখবেন প্লিজ।

আমি এই আইল্যান্ডে আসার পর একদিন ৭ জন রোগী এডমিট করেছি।

একটা বাচ্চা ছিলো এজমার,বাকি ৬জন ডেঙ্গু রোগী।

মিনিস্ট্রি দেখলো এই হেলথ সেন্টারের ৭টা বেড ফিলাপ।

তারা ডাইরেক্টরকে কল দিয়ে ব্যাখ্যা চাইলো আমার থেকে।

আমি প্রতিটি রোগী গাইড লাইন অনুযায়ী এডমিশন ক্রাইটেরিয়া মেনে এডমিট করেছি কিনা।

আমি ব্যাখ্যা দিলাম।তারা সন্তুষ্ট হলো।

তারা তখন আমাকে জানালো,যেহেতু এখানে আর বেড খালি নেই,নেক্সট এডমিশন দেওয়ার মতো পেশেন্ট আসলে এটল হসপিটালে রেফার করতে।

নীচের ছবিটা খেয়াল করুন।

কোন মানুষ এভাবে চিকিৎসা নিতে পারে?

ফ্লোরে শুয়ে একটা দেশের নাগরিক কেন চিকিৎসা নিবে?

কেন একশো বেডের হাসপাতালে ৫০০ রোগী থাকবে?

কিভাবে একশো বেডের হাসপাতালের ডাক্তার নার্স অন্যান্য স্টাফ দিয়ে আপনি ৫০০ রোগীকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবেন?

এদেশের মানুষের জীবনের মূল্য এত সস্তা কারা করলো?

এদেশের মানুষকে পশুর মতো ট্রিট করছে কারা?

মালদ্বীপে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া কোন মানুষের একটা প্যারাসিটামল কিনে খাওয়ার সুযোগ নেই।

সেখানে আমার দেশের একজন ডেঙ্গু পজেটিভ রোগীকে স্টেরয়েড ও ব্যথার মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা করছে LMAF নামক হাতুড়ে ডাক্তার।

একজন ডেঙ্গু রোগীকে ব্যথার মেডিসিন ও স্টেরয়েড দেওয়া কবীরা গুনাহ।

এই রোগীর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হয়ে মারা গেলে এর দায় কি সেই LMAF  নিবে?

দায় নেওয়ার কথা পরে, কিভাবে একজন হাতুড়ে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন,অপচিকিৎসা ও মারাত্মক ভুল চিকিৎসা দিতে পারেন?

দুনিয়ার কোথাও মানুষের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা সম্ভব?

ডাক্তার বেশি টেস্ট দেয়।

ডাক্তার কমিশন খায়।

ডাক্তার আজেবাজে কোম্পানির মেডিসিন লিখে।

ডাক্তার রোগীর কথা শুনেনা।

এসব অভিযোগ ঢালাওভাবে সত্য না।

কিন্তু এসব অভিযোগ ভিত্তিহীনও না।

কিন্তু কে নির্ধারণ  করবে কোন রোগীর কয়টা টেস্ট লাগবে?

কোন রোগীর জন্য সঠিক চিকিৎসা কি?

সিস্টেমের গোড়ায় হাত দেন।

সিস্টেম টা ভুলে ভরা।

সিস্টেমটা আপনাকে মানুষ হিসেবে, দেশের মালিক হিসেবে ট্রিট করছেনা সেটা ভেবে দেখেছেন?

আপনি যেই নেতার পেছনে মিছিল দেন,যেই নেতার জন্য অন্য মানুষের মাথা ফাটান,সেই নেতা ও তার পরিবার সন্তানরা সবাই বিদেশে চিকিৎসা নেয়।

বাংলাদেশের কোন এমপি কোনদিন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছে?

বাংলাদেশের কোন মন্ত্রী কোনদিন জেলা সদর হসপিটালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে?

এমপি মন্ত্রীদের স্ত্রী পুত্র কন্যা পরিজনরা কোনদিন উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছে?

নেতারা চিকিৎসা নিবেন বিদেশে, নেতারা লুটপাট করবেন,আর আপনার সন্তানকে সরকারি হাসপাতালে ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হবে, আপনি আবার সেই নেতার জন্য গলা ফাটান।

এজন্যই আপনাদের কপালে জুটে LMAF,আপনাদের সন্তানদের জন্য জুটে ফ্লোর।

সিস্টেমের গোড়ায় হাত না দিয়ে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে মনের জ্বালা মিটাতে পারবেন কিন্তু কোনদিন বাংলাদেশের হেলথ সিস্টেমে আপনি মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবেন না।

এর দায় কোন ডাক্তারের না,আপনারা যাদের জন্য গলা ফাটান, ভোট বাক্স দখল করেন, দিনের ভোট রাতে দেন,সব দায় তাদের।সাথে অনেক দায় আমলাদের।

যাদের দায়, তাদের টুটি চেপে যেদিন ধরতে পারবেন,

যেদিন আপনাদের এমপি মন্ত্রীদেরকে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করতে পারবেন সেদিন বাংলাদেশের হেলথ সিস্টেমে আপনি মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবেন,তার আগে নয়।

ফেসবুক টাইমলাইন থেকে