ভারতের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলের তামু জেলায় তড়িঘড়ি শেষকৃত্যের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। ত্রিপলের ওপর পাশাপাশি রাখা কয়েকজন পুরুষ ও কিশোরের মরদেহ। রক্তমাখা সামরিক পোশাক পরিহিত মরদেহগুলো কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। সেগুলোর ওপর মাছি ঘুরছে। গুঁড়ি দিয়ে তৈরি গণচিতায় দাহ করা হবে সেগুলো।
গত ১৪ মে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে মিয়ানমারের পা কা ফায়ের (পিকেপি) ১০ সদস্য নিহত হন। তাঁদের মধ্যে তিনজন কিশোর। দাহ করার জন্য রাখা ওই মরদেহগুলো এই ব্যক্তিদের। পিকেপি দেশটির পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফ) অংশ।
২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সু চির দলের সরকার উৎখাত হওয়ার পর ওই সরকারে থাকা দল ও ব্যক্তিরা মিলে গঠন করে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি)। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি এনইউজির গঠন করা সশস্ত্র বাহিনী ‘পিডিএফ’ লড়াই করছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেছে, সীমান্তের ওপারে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত আছে সন্দেহে ১৪ মে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের সীমান্তচৌকিতে টহল দেওয়া আধা সামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলসের (এআর) একটি ব্যাটালিয়ন যুদ্ধসরঞ্জাম বহনকারী ১০ সশস্ত্র ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে।
ভারতীয় ওই সেনারা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী মণিপুর রাজ্যের চান্দেল জেলায় মোতায়েন ছিলেন—এটি মিয়ানমারের তামু জেলা লাগোয়া।
দুই বছর ধরে মণিপুরে জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত চলছে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই মিয়ানমার থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ওই উত্তেজনা উসকে দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে।
তবে এনইউজি ১৪ মের ঘটনা নিয়ে ভারতের বিবরণকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের সদস্যরা ভারতের ভেতরে কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষে নিহত হননি; বরং সেনারা তাঁদের বন্দী করে নির্যাতন ও কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুদ্ধ-সংঘাত পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মিয়ানমারে প্রায় পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পর ভারতের সঙ্গে দেশটির প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার (৯৯৪ মাইল) দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে সক্রিয় প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর একধরনের বোঝাপড়া গড়ে ওঠে। এর আওতায় উভয় পক্ষই কার্যত একে অপরের বিষয়ে নাক না গলানোর নীতি অনুসরণ করত।
তামু জেলায় ওই হত্যাকাণ্ডের পর সেই বোঝাপড়ার অবসান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি এনইউজির জন্য বড় ধাক্কা। এতে ডজনখানেক বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী ও মিয়ানমারের যুদ্ধ এড়িয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নেওয়া হাজারো শরণার্থীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাঁরা এখন ওই সহিংস ঘটনার প্রভাব সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
তামু পা আ ফা সদস্য থিডা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘যোদ্ধাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তবে শরণার্থীরা বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁরা সবাই এখন অনিরাপদ বোধ করছেন।’
এক বছর ধরে নয়াদিল্লি মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে উদ্যোগী হয়েছে। এ উদ্যোগের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জাতিগত গোষ্ঠীগুলো। এরা বহু প্রজন্ম ধরে অবাধে দুই দেশের সীমান্তের এপার-ওপার চলাচল করে এসেছে—এমনকি ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই।
থিডা বলেন, ‘প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমরা নিরাপদ বোধ করতাম। কিন্তু এ ঘটনার পর আমরা চরম উদ্বেগে আছি। আমরা জানি, ভারতীয় সেনারা আবারও এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।’
আল–জাজিরাকে পা আ ফায়ের এই সদস্য আরও বলেন, ‘সেনা অভ্যুত্থানের পর এই চার বছরে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কিন্তু এখন, এটা ঘটেছে। আর প্রথমবারের মতো যখন এমন ঘটনা ঘটেছে, এর অর্থ হলো, দ্বিতীয়বার অথবা তৃতীয়বারও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এটাই সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ।’
আগাম অভিযান, নাকি পাল্টা আঘাত
১২ মে, পিকেপির ১০ সদস্য তামু এলাকায় তাঁদের নতুন ক্যাম্পে পৌঁছান। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁদের আগের অবস্থান জেনে যাওয়ায় তাঁরা ক্যাম্পের স্থান পরিবর্তন করেন। তামুতে অবস্থানরত এক জ্যেষ্ঠ এনইউজি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় দুই ব্যক্তি আলাদা সূত্রে আল–জাজিরাকে এ তথ্য দিয়েছেন।
এনইউজি কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা আগেভাগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ওই ক্যাম্পের উপস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন।
থিডা বলেন, ‘আসাম রাইফেলসের (এআর) সদস্যরা ১২ মে নতুন ক্যাম্পের স্থান দেখে গেছেন। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে তাঁদের জানানো হয়েছে।’
পরে কী ঘটেছিল, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কারণ, ভারতীয় কর্মকর্তারা ও এনইউজি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছে। এমনকি ভারতীয় কর্মকর্তাদের দেওয়া বিবৃতিতেও পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে।
১৪ মে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড দাবি করেন, তাঁদের সেনারা গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চান্দাল জেলার নিউ সামতাল এলাকায় সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরা তাঁদের দিকে গুলি ছোড়েন এবং বন্দুকযুদ্ধে ১০ সশস্ত্র ব্যক্তি নিহত হন।
দুই দিন পর ১৬ মে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘আসাম রাইফেলসের একটি টহল দল লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। পাল্টা জবাবে তারা সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ছদ্মবেশ নেওয়া ১০ জনকে হত্যা করে এবং ঘটনাস্থল থেকে ৭টি একে-৪৭ রাইফেল ও একটি রকেটচালিত গ্রেনেড লঞ্চার উদ্ধার করে।’
পাঁচ দিন পর, ২১ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিহত ব্যক্তিরা পিকেপির সদস্য বলে শনাক্ত করে।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘(সীমান্তে) যেখানে বেড়া নির্মাণের কাজ চলছে, সেই এলাকা নিরাপদ করতে পাঠানো একটি টহল দল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে। হামলাকারীদের উদ্দেশ ছিল নির্মাণকর্মী বা আসাম রাইফেলসের সেনাদের ক্ষতি করে বেড়া নির্মাণের কাজ থামানো।’
এ বিষয় নিয়ে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছেন অবসরপ্রাপ্ত এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা। এক দশক ধরে নয়াদিল্লিকে তিনি মিয়ানমারবিষয়ক নীতিতে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ১৪ মের ঘটনা নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিগুলোর অসংগতি তুলে ধরেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ভারতীয় সেনারা কী গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আগাম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, নাকি মিয়ানমার থেকে আসা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?
ওই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আল–জাজিরাকে তাঁর নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডগুলো ব্যাখ্যা করা কঠিন। এটা এমন কিছু, যা নিয়মের বাইরে গিয়ে ঘটেছে। এটা উসকানিমূলক অভিযান (মিয়ানমারের বিদ্রোহীর তরফে) বা পাল্টা হামলা (ভারতীয় সেনাদের) কোনোটিই হতে পারে না।’
আল–জাজিরা এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য কয়েক দফা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
সীমান্তবেড়া নিয়ে উদ্বেগ
মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ওপর গবেষণা করছেন অংশুমান চৌধুরী। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ওপর নজর রাখা পর্যবেক্ষকেরা সীমান্তবর্তী তামু অঞ্চলে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এটি বোধগম্য নয় এবং যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি হওয়া উচিত ছিল না।’
মিয়ানমার-ভারত সীমান্তে বিভেদের মূল কারণ সীমান্তবেড়া। এটি বহু পুরোনো বিষয়। অংশুমান বলেন, ‘এটি সব সময়ই সীমান্তে মতবিরোধের কারণ হয়েছে এবং উভয় দিকের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ভুল–বোঝাবুঝির কারণে তা খুবই সহিংস সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে।’
গত বছর যখন নয়াদিল্লি প্রথমবারের মতো দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবাধ চলাচল নীতিকে বাতিলের উদ্যোগ নেয়, তখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো হতবাক হয়ে পড়ে। দুই দেশের মধ্যে ওই নীতির আওতায় স্থানীয় বাসিন্দারা সীমান্ত পেরিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারতেন।
কিন্তু গত বছর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলে, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ও মিয়ানমার-সংলগ্ন অঞ্চলের জনসংখ্যাগত কাঠামো অক্ষুণ্ন রাখবে।
মণিপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগুরু মেইতেই এবং সংখ্যালঘু কুকি ও নাগা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার ওই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই এবং কুকি ও নাগা সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সহিংসতায় ২৫০ জনের বেশি নিহত হন। বাস্তুচ্যুত হন হাজার হাজার মানুষ।
রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা মেইতেই জনগণের মধ্যে নিজেদের সমর্থন জোরদার করার জন্য অস্থিরতা আরও উসকে দিয়েছে। তবে সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এখন তামুতে এ হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে অসন্তোষের নতুন সীমান্ত উন্মোচিত হয়েছে বলে মনে করেন অংশুমান। তিনি বলেন, ‘এমন এক সীমান্তে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, যেখানে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত অনেক সশস্ত্রগোষ্ঠী এত দিন ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে শান্তি বজায় রেখে চলছিল।
অংশুমান বলেন, ‘এসব মৃত্যু ভারতীয় বাহিনী ও সেসব গোষ্ঠীর মধ্যে “রুলস অব এনগেজমেন্ট” বা সংঘাত-সম্পর্কিত অলিখিত নিয়ম ছিল, তা বদলে দিতে পারে। মনে রাখবেন, (মিয়ানমারের) অন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এ ঘটনা খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে, এ ধরনের ঘটনা খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’