ভিনদেশী তরুণীর পাশে ১৫ ঘণ্টার দুঃসহ বিমানযাত্রা

ভিনদেশী তরুণীর পাশে ১৫ ঘণ্টার দুঃসহ বিমানযাত্রা

এবারের ওয়াশিংটন ডিসি যাত্রা হতে পারত একটা সাদামাটা একঘেয়ে ক্লান্তিকর ভ্রমণ। কারণ যাচ্ছি দাপ্তরিক কাজে, একা একা। কিন্তু ঢাকা থেকে যাত্রাটা হয়ে উঠল আনন্দদায়ক ও আরামদায়ক। বিমান ফুল বুকড থাকায় কাতার এয়ারওয়েজ দয়া পরবেশ হয়ে বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড করে দিল। রাত্রিকালীন ফ্লাইটে নাক ডেকে ঘুমিয়ে ছয় ঘণ্টা পার করে দিলাম। দোহায় স্টপওভারটাও ভালো ছিল। সুক ওয়াকিফ, কাটারা, পার্ল কাতারসহ আধুনিক দোহা ঘুরে বেড়ালাম, জুমার নামাজ পড়লাম কাতারের জাতীয় মসজিদে। মাত্র ৬ কাতারি রিয়ালে বা বাংলাদেশি ২০০ টাকায় সারাদিনের মেট্রো পাস কিনে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগল।

বিপত্তির শুরু দোহা থেকে ডিসির যাত্রায়। ভোর বেলায় দোহার এয়ারপোর্টে চলে আসলাম নিমিষেই। চেকইন ইমিগ্রেশন নিরাপত্তা তল্লাশি হল মুহূর্তের মধ্যে। সবকিছু এত ফাস্ট ও ইফিশিয়েন্ট হল যে ফ্লাইটের বহু আগেই এয়ারপোর্টের ভেতরে এসে বসে আছি। ভাবলাম লাউঞ্জে একটু ঢুঁ মারি। আল মাহা লাউঞ্জে ঢুকার জন্য দেখি বিশাল লাইন। দোতলায় লাউঞ্জ। নিচ তলা থেকেই লাইন শুরু। মনে হল বিনামূল্যে খাবার বিতরণের লাইন। আজকাল সবার কাছেই লাউঞ্জ কি বা প্রায়োরিটি পাস আছে।

যাইহোক সময়মত বিমানে চলে গেলাম। আমার জানালার ধারে সিট। গিয়ে দেখি আমার পাশের সহযাত্রী দুজন ভিনদেশী তরুণী। তাঁরা আগেই আসন অলঙ্কৃত করে বসে আসেন। তাঁদের চেহারা দেখে মনে হল তাঁরা অধীর উদ্দীপনা ও উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছেন কে তাদের সহযাত্রী হচ্ছে। আমি সবিনয়ে স্মিত হাসিতে জানালাম আমার সিট জানালার পাশে। তাতেই তাঁদের চেহারায় ক্রোধ ফুটে উঠল। তাঁরা সিট ছেড়ে চলে গেলেন। অপেক্ষায় থাকলাম তরুণীর পরিবর্তে কে আমার পাশে আসন গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তরুণী দুজন ফিরে এলেন, একরাশ বিরক্তি নিয়ে আসন নিলেন আমার পাশে। আমার কেবিন লাগেজটি আমার সিটের উপরের ওভারহেড কাউন্টারে রাখা যায়নি জায়গা ছিল না বলে। কেবিন ক্রু বলেছেন তিনি সেটার টেক কেয়ার করবেন। তাই কেবিন ব্যাগটি আইলে রেখে আমি আমার সিটে বসে ছিলাম কিন্তু সেটার দিকে নজর রাখছিলাম যতক্ষণটা সেটা ওভারহেড কাউন্টারে রাখা হয়। যেহেতু আমি আইলে থাকা আমার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমার পাশের মিডল সিটের সহযাত্রী তরুণীর মনে হচ্ছিল আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি! তিনি আমার দিকে এমন লুক দিলেন যেন আমি আন্তঃদেশীয় ডাকাত দলের সদস্য। আমি তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম, “আই অ্যাম লুকিং অ্যাট মাই ব্যাগ, ম্যাম”। আমার আশ্বাস তরুণীকে আশ্বস্ত করতে পারল বলে মনে হল না। ব্যাগের মায়া ছেড়ে আমি জানালার দিকে উদাস নয়নে তাকাব বলে উইন্ডো ব্লাইন্ড কিছুটা খুলতেই তরুণী ক্ষিপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ক্লোজ দ্য উইন্ডো!”

আদিষ্ট হয়ে জানালা বন্ধ করে ফেললাম। ভাবলাম এবার কোনদিকে তাকাব, ডানে বাঁয়ে তাকানো তো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! প্লেনে যাত্রী উঠা শেষ হবার পর তরুণী কেবিন ক্রুকে ডেকে বললেন তাকে সিট পরিবর্তন করে দিতে। কেবিন ক্রু আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে এবং তাঁর প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে  বললেন, “I understand your situation. Unfortunately, we are fully booked.”

আমার মনে হল আমাকে না জানি অফলোড করে দেয়! আমি জানালার দিকে যতটা সম্ভব ঘেঁষে বসলাম। ইতিমধ্যে তরুণী আমাকে দেওয়া কম্বল আর্মরেস্টের উপর রেখে তাঁর আর আমার মধ্যে একটা বাফার জোন তৈরি করলেন। আমি ভাবতে লাগলাম এই অবস্থায় পনের ঘণ্টা কিভাবে কাটাব! আমি আমার স্ক্রিনে একটা মুভি অন করলাম। দেখি আমার সহযাত্রী তরুণী লক্ষ্য করছেন আমি আমার স্ক্রিনে কি দেখছি! ও গড! কি করব! ভাবলাম মুভিতে যদি অন্তরঙ্গ কোনো দৃশ্য চলে আসে তাহলে তিনি বুঝি আমাকে চলন্ত প্লেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন! আমি ফ্লাইট পাথ অন করে দেখতে থাকলাম প্লেন কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে, কত সময় হল প্লেন ছেড়েছে, কত সময় বাকি আছে!

ইতিমধ্যে তরুণী দুই পা সামনের সিটের হাতলে দিয়ে বসে পড়েছেন। সামনের সিটে বাচ্চা আছে, তাই হয়ত কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু তাঁর পা আমার জায়গা আরও সংকুচিত করে দিয়েছে। আমি জানালার দিকে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে খাবার আসলে তরুণী অ্যালকোহলিক বেভারেজ চাইলেন। ক্রু জানালেন প্লেন টার্বুলেন্স মোডে আছে, সিট বেল্ট সাইন অন আছে, তাই এখন অ্যালকোহল সার্ভ করা যাবে না। তরুণী আরও হতাশ হলেন মনে হয়।

ইতিমধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাব ভাবছি কিন্তু ভয়ে সিট ছেড়ে উঠার সাহস করলাম না। কিন্তু কতক্ষণ বাথরুম চেপে রাখব! একসময় সাহস করে বললাম, আমাকে বাথরুমে যেতে হবে! তিনি দেখলাম খুশিমনে দুই পা সিটের উপর তুলে দিয়ে বললেন, “গো”! আমি ভাবলাম যদি তাঁর গায়ে টাচ লাগে তাহলে তো আমি শেষ। সেই মেয়ের পাশের মেয়েটি সিট থেকে উঠে জায়গা করে দিয়েছে। আমি নিজের পেটের স্ফিতি কমাতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে যতদূর সম্ভব সামনের সিটে ঘেঁষে ত্বরিতগতিতে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু আরেক কাণ্ড ঘটে গেল। নিচে থাকা সেই তরুণীর ড্রেসের সাথে ম্যাচিং লাল পার্স ও জুতা আমার পায়ের আঘাতে বাইরে ছিঁটকে পড়ল। আমার তো মাথায় হাত! আমি সরি বলে তার পার্স ও জুতা কালেক্ট করে তাঁর হাতে দিলাম। আল্লাহর রহমতে তিনি কোনো ধমক দেননি, শুধু বললেন, বি কেয়ারফুল!

আমি বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখি সেই তরুণী আমার সিট দখল করে ঘুমিয়ে পড়েছেন! আমি কী করব বুঝতে পারছি না। ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করি। প্লেনের এ মাথা থেকে ওই মাথা কয়েকবার চক্কর দিলাম। অপ্রয়োজনীয়ভাবে কেবিন ক্রুদের সাথে গল্প করে সময় কাটালাম। খিদে না পেলেও বাচ্চাদের মত চিপস খেলাম জুস খেলাম। ক্রুদের জিজ্ঞেস করলাম নেক্সট মিল কখন দেবে। ক্রুদের বুঝি আমার প্রতি মায়া লাগল। বলল, তোমার ক্ষুধা পেয়েছে? আমি বললাম, না, এমনিতেই জানতে মন চাইল।

ঘণ্টা খানেক পর সাহস সঞ্চয় করে আমার সিটের দিকে ফিরে গেলাম। নরম সুরে মিনমিন করে ডাকলাম ঘুমন্ত তরুণীকে। তাঁর কোনো সাড়া নেই। আইলের সিটের তরুণী সেই তরুণীকে ডেকে উঠাল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি উঠলেন। এবার আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের সিটে যেতে রাজি হইনি। তিনি সিট থেকে উঠে এসে আমাকে জায়গা করে দিলেন।

সিটে এসে আমি স্ক্রিনে কুরআন তেলওয়াত শুনা শুরু করলাম। দেখলাম সেই তরুণী আঁড়চোখে দেখছেন আমার স্ক্রিনে কি চলে। আমি ভয় পেলাম না। আমাকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতে দেখে দেখি তিনিও কুরআন তেলাওয়াত শুনছেন। ধীরে ধীরে মনে হল তিনি  কিছুটা ইজি হয়েছেন। আমি যে একটা ক্রিমিনাল না সেটা মনে হয় তাঁর মন থেকে ধীরে ধীরে কাটছিল।

সময় কেটে গেল অনেকক্ষণ। দ্বিতীয় দফা খাবারের সময় হয়ে এল। আমরা সামনের দিকে ছিলাম। এবার খাবার দেওয়া হচ্ছিল পেছন দিক থেকে। তাই আমাদের কাছে খাবার আসতে আসতে খাবারের অপশন কমে আসল। খাবারের অপশন বর্ণনা করে কেবিন ক্রু যখন জিজ্ঞেস করলেন কি খাব তখন আমি ও সেই তরুণী একসাথে বললাম চিকেন পাস্তা। কেবিন ক্রু বললেন, আনফরচুনেটলি আমার কাছে একটা চিকেন আছে আরেকটা বিফ। তোমাদের দুজনের একজন চিকেন পাবে। বল কাকে দেব। আমি স্বাস্থ্যগত কারণে বিফ খেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু সেই তরুণী আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে আমাকে তাঁর পছন্দকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমি হাসিমুখে বললাম, ওকে বিফ পর মি। কেবিন ক্রু হেসে ধন্যবাদ জানালেন আমাকে। সেই তরুণীর মুখে নেই হাসি, নেই কৃতজ্ঞতা। মনে হল she deserves what she wants!

দেখতে দেখতে প্লেন প্রবেশ করল আমেরিকার আকাশে। নিচে তাকিয়ে দেখি সবুজ গাছগুলোর রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গ্রীস্মের গ্রিনারি নেই, নেই তারুণ্যের উচ্ছলতা। আমাদের তারুণ্যও ক্ষণস্থায়ী, একসময় সেই গাছগুলোর মতই ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে যায়। আমাদের পনের ঘণ্টার যাত্রার সমাপ্তি হলো।

দায় অস্বীকৃতি: এটি একটি নিছক অভিজ্ঞতা বর্ণনা, যার মধ্যে আবেগের আতিশয্য আছে। এই লেখার সাথে কোনো ব্যক্তির মিল পাওয়া গেলে সেটা নিতান্তই কাকতালীয়।

লিংক: https://www.facebook.com/share/p/155rf3dFw3/