আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী গড়ছে বাংলাদেশ

আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী গড়ছে বাংলাদেশ

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশ তার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণ পরিকল্পনা “ফোর্সেস গোল ২০৩০” পুনর্বিবেচনা করছে। সশস্ত্র বাহিনীকে একটি আধুনিক ও বহুমুখী সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করার জন্য ২০০৯ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরে ২০১৭ সালে পরিকল্পনাটি সংশোধন করা হয়। তিন বাহিনীর জন্য আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ, জনবল বৃদ্ধি এবং কৌশলগত চাহিদা পূরণের জন্য একটি প্রতিরক্ষা শিল্প ভিত্তি তৈরি করা এই কর্মসূচির লক্ষ্য। এই পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য ফলাফল দিলেও ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এটি নতুন করে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে। রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা সরকার বিরোধী প্রতিরোধ বাহিনী ‘আরাকান আর্মি’র নিয়ন্ত্রণে। সীমান্ত এলাকায় ঘন ঘন লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটির সাথে বাংলাদেশের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে, ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শাসককে আশ্রয় দেয়ার পর থেকে এ অবস্থা চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ বক্তব্য ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ রয়েছে। এসব বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের সাথে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ হুমকি, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর কুকি-চিন-এর মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণ এবং জনবল বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে।

এখন পর্যন্ত যেসব আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় কম হলেও তা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটিয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংযোজনের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি সাঁজোয়া যান বিটিআর-৮০, যা এই বাহিনীকে উভয়চর গতিশীলতা দিয়েছে। ১০ জন সেনা বহন করতে সক্ষম এই সাঁজোয়া যানে রয়েছে একটি ১৪.৫ এমএম ক্যানন ও একটি ৭.৬২ এমএম কোঅ্যাক্সিয়াল মেশিনগান। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য বিটিআর-৮০ খুবই কার্যকর।

সেনাবাহিনী অনুসন্ধান এবং টহলের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা তুরস্কের তৈরি হালকা সাঁজোয়া যান ‘ওটোকার কোবরা’ সংগ্রহ করেছে। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন চাইলে এটিকে মেশিনগান, গ্রেনেড লঞ্চার বা এন্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা যায়, যা যুদ্ধক্ষেত্রে এর বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে। এছাড়াও চীন থেকে কেনা হয়েছে মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এমবিটি ২০০০ এবং হালকা ভিটি-৫ ট্যাঙ্ক। এমবিটি-২০০০-এ রয়েছে ১২৫ এমএম গান এবং অত্যাধুনিক কম্পোজিট আর্মার, যা প্রচলিত যুদ্ধের উপযুক্ত। অন্যদিকে,  চ্যালেঞ্জিং ভূখণ্ডে ব্যতিক্রমী গতিশীলতা প্রদান করে ভিটি-৫।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরের শক্তি বৃদ্ধি করেছে তুরস্ক থেকে সংগ্রহ করা টিআরজি-২৩০ ও টিআরজি-৩০০ কাসিরগা মাল্টিপল-লঞ্চ রকেট সিস্টেম। এর সঙ্গে আছে সার্বিয়ান সেলফ-প্রপেলড হাউইটজার – নোরা বি-৫২। এতে সেনাবাহিনীর দূরপাল্লার ফায়ারপাওয়ার অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

“ফোর্সেস গোল ২০৩০” উদ্যোগের অধীনে নৌবাহিনীর শক্তিও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন থেকে দুটি‘ মিং-ক্লাস সাবমেরিন সংগ্রহের ফলে সমুদ্র অঞ্চল সুরক্ষিত করার জন্য কৌশলগত সামর্থ্য এবং সমুদ্রের নীচে নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অত্যাধুনিক টর্পেডো সজ্জিত এই সাবমেরিনগুলোর আধুনিক সনাক্তকরণ ব্যবস্থা বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করে।

নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বহরে যুক্ত হয়েছে গাইডেড মিসাইল দিয়ে সজ্জিত টাইপ ০৫৩এইচ৩ ফ্রিগেট এবং টাইপ ০৫৬ স্টিলথ কর্ভেট। ফলে প্রতিরক্ষা ও নজরদারি মিশনের জন্য এই বাহিনীর অপারেশনাল ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নৌবাহিনীর এভিয়েশন শাখার জন্য কেনা হয়েছে ডর্নিয়ার ২২৮ মেরিটাইম পেট্রোল বিমান এবং অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার। বাংলাদেশের সামুদ্রিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে হুমকি সনাক্তকরণ এবং সম্পদ রক্ষার জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়াক-১৩০ এবং কে-৮ এর মতো উন্নত প্রশিক্ষণ বিমান অন্তর্ভুক্তি বিমান বাহিনীকে বেশ শক্তিশালী করেছে। এগুলো হালকা যুদ্ধবিমান হিসেবেও কাজে লাগানো যায় এবং উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ও অপারেশনাল প্রস্তুতি – উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশ নিজেই এফ-৭বিজিআই ইন্টারসেপ্টর তৈরি করছে, যা কার্যকর আকাশসীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করে। অন্যদিকে, স্বল্প-পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমএম-৯০ সংযোজনের মাধ্যমে আকাশ হুমকির বিরুদ্ধে কৌশলগত অঞ্চল প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এসব সিস্টেমের পরিপূরক হিসাবে ইতালি থেকে সেলেক্স র‌্যাট-৩১ডিএল রাডার কেনা হয়েছে, যা সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ সনাক্ত করার মাধ্যমে দেশটির নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।

সরঞ্জাম আপগ্রেড করার পাশাপাশি, “ফোর্সেস গোল ২০৩০” পরিকল্পনা অনুযায়ী জনবল বৃদ্ধি এবং ইউনিট পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী তিনটি নতুন পদাতিক ডিভিশন – ৭ম, ১০ম এবং ১৭তম প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থল-ভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা কোর সম্প্রসারণ এবং প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেডে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে এসব প্রচেষ্টা এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি এবং বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি। প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তির মাধ্যমে এসব ফ্যাক্টরিতে হালকা অস্ত্র, ইউটিলিটি যানবাহন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি করা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য “ফোর্সেস গোল ২০৩০” পুনর্বিবেচনা একটি কৌশলগত সুযোগ নিয়ে এসেছে। এর ফলে দেশটি বর্তমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালভাবে মোকাবেলা, জাতীয় সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। সশস্ত্র বাহিনীকে অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত, প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উভয় হুমকির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

আর্মিরিকগনিশন থেকে অনুবাদ