দিল্লির এক বস্তিতে বাস করা পরিচ্ছন্নতা কর্মী করুণ কণ্ঠে বলেন যে তাকে তার গর্ভবতী স্ত্রী ও ছেলেসহ নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের এক ধনী কৃষকের অভিযোগ, তার মাকে পুলিশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আটকে রেখেছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের এক মাজারের ৬০ বছর বয়সী খাদেম জানান, তাকে চোখ বেঁধে মারধর করে, নৌকায় তুলে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এদের সবাই অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন – অর্থাৎ রাজ্য সরকারের দৃষ্টিতে এরা অভিবাসী। এরা ক্রমবর্ধমান হারে দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। আর, ভারত সরকার এই অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জরুরি বলে। অধিকার গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে যে এপ্রিলে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে, মুখের ভাষার কারণে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আটক অভিযান চালানো হচ্ছে।
হাজার হাজার ভারতীয় বাংলাভাষী, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম, তাদেরকে আটক বা বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে। এরা মূলত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে এসেছেন, যেখানে বাংলাই প্রধান ভাষা; কয়েক দশক ধরে রাজ্যের তরুণরা কাজের সন্ধানে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে ভীড় করছে।
অভিযোগ করা হয়, লাখ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি ভারতে বাস করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের যেসব এলাকায় বাংলাভাষীদের বসবাস সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অভিযান চালায়। এরপর দাবি করে যে তারা অবৈধ অভিবাসী থাকার প্রমাণ পেয়েছে। অথচ ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই একটি সরকারি ভাষা বাংলা। সীমান্তের উভয় পাশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে রাজধানী নয়াদিল্লির উপশহর গুরুগ্রামের কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসী সনাক্ত করতে অভিযান চালাচ্ছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, গুরুগ্রামের পুলিশ ভারতে বৈধভাবে বসবাসের প্রমাণসহ শত শত লোককে আটক করে এবং পরে ছেড়ে দিয়েছে। জানা যায়, অভিযান শুরুর পর থেকে শত শত গরীব বাংলাভাষী শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
গুরুগ্রাম পুলিশ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার বলেন, যাচাই অভিযানে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আটক করা হয়েছে এবং ১০ জনকে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী পাওয়া গেছে। তিনি দাবি করেন যে শহর ছেড়ে অনেকের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি “গুজব”। তবে গুরুগ্রাম শহরের আইনজীবী সুপান্ত সিনহা জানান পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ১,০০০।
ভারতের চারটি রাজ্যের পুলিশী অভিযান চালানো এলাকাগুলোতে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম ও হিন্দুরা বলেছেন যে তারা কর্তৃপক্ষের হয়রানীর শিকার হওয়ার ভয়ে ভীত।
১৮ বছর বয়সী হিন্দু অভিজিৎ পাল জানান, তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুরুগ্রামে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য এসেছেন। তার বস্তিতে অভিযান চালানোর পর পুলিশ তাকে পাঁচ দিন আটক রাখে। পরিচয়পত্র দেখানোর পরও পুলিশ থাকে ছাড়েনি। সমাজকর্মীরা পুলিশকে তার ভারতীয় জাতীয়তার প্রমাণ হিসেবে অতিরিক্ত নথি দেওয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে, লাখ লাখ ভারতীয়ের কাছে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার মতো নথিপত্র নেই।
পাল আবার আটক হওয়ার ভয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন। তিনি বলেন, আমি সেখানে থাকলে আবারো ধরা পড়তে পারি। কারণ আমি বাংলায় কথা বলি। পাল এখন বেকার।
অধিকার গোষ্ঠী এবং আইনজীবীরা সরকারের নির্বিচারে দমন অভিযান চালানোর জন্য সরকারের সমালোচনা করেন। তারা জানান, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এপ্রিলের সন্ত্রাসবাদের ঘটনাকে দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের পদ্ধতিগত প্রচারণা আরও তীব্র করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে।
হামলার পর থেকে ভারতের বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্যগুলোতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বা মুসলিমকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, গুজরাটে কমপক্ষে ৬,৫০০ জন, কাশ্মীরে ২০০০ জন এবং রাজস্থানে প্রায় ২৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। মে মাসে রাজস্থানে তিনটি নতুন আটক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতজনকে পুশ-ইন করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ভারত থেকে প্রায় ২০০০ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুশ-ইন করার পর ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণকারী কয়েক ডজন মানুষকে ভারত সরকার পুনরায় দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এশিয়ার ডেপুটি ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি জানান, সরকারের এই কঠোর অভিযান মূলত মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে।
২১ বছর বয়সী আমির শেখ পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য গিয়েছিলেন। তার চাচা আজমল শেখ জানান, তার রাজ্য পরিচয়পত্র এবং জন্ম সনদ থাকা সত্ত্বেও জুন মাসে পুলিশ তাকে আটক করে। তিন দিন আটক থাকার পর পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
জুনের শেষের দিকে, পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণকারী ২৭ বছর বয়সী পরিচ্ছন্নতা কর্মী দানিশ শেখকে পুলিশ তার গর্ভবতী স্ত্রী এবং ৮ বছরের ছেলেসহ আটক করে। শেখ বলেন, পাঁচ দিন আটক থাকার পর তার পরিবারকে জঙ্গলে নিয়ে ফেলে রাখা হয় এবং বাংলাদেশের দিকে হেঁটে যেতে বলা হয়। ভারতে পারিবারিক জমির রেকর্ড এবং ভারতীয় পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তারা তখন থেকে জঙ্গলে আটকে আছে। শেখের স্ত্রী সোনালী খাতুন বলেন, জানি না আমরা কখন আবার বাড়ি যেতে পারব।
৬০ বছর বয়সী ইমরান হোসেন বলেন, গুজরাটে তার পাড়ায় পুলিশ অভিযান চালানোর পর তাকে চোখ বেঁধে, মারধর করা হয় এবং পাঁচ দিনের নৌ-পথ পারি দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়। হোসেন বলেন, আমি এখনও ঘুমানোর চেষ্টা করলে মানুষের কান্না শুনতে পাই।
জাতীয় এবং রাজ্য উভয় পর্যায়ের বিজেপি নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা “অনুপ্রবেশকারীদের” ভারতের জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জুলাই মাসে একটি এক্স পোস্টে “উদ্বেগজনক জনসংখ্যাগত পরিবর্তন” সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন যে তার রাজ্য “অনিয়ন্ত্রিত মুসলিম অনুপ্রবেশকে কঠোর হাতে দমন করবে।”
আসামে, জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম এবং এদের বাংলাভাষী পরিচয় কয়েক দশক ধরে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের সর্বশেষ ”বিতাড়ন অভিযানের” সময় শর্মা ১৯৫০ সালের একটি আইন উল্লেখ করেছেন, যা রাজ্যকে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনাল এড়িয়ে সন্দেহভাজনদের নির্বাসনে পাঠানোর অনুমতি দেয়।
আসামে নাগরিকত্ব বিচার নিয়ে গবেষণা করা আইনজীবী মহসিন ভাট বলেন, এ ধরনের বক্তব্য খুবই ভয়াবহ।
আসামের কৃষক মালেক ওসতার গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভাবছেন কিভাবে তার আটক মাকে ছাড়িয়ে আনবেন। তিনি বলেন, জুনের প্রথম দিকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং মা কোথায় আছে পুলিশ সেটাও তাকে জানাবে না।
তিনি বলেন, আমার মায়ের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এবং রেশন কার্ড আছে, কিন্তু পুলিশ কোন কথা শুনেনি।
ওসতার বলেন যে তার পরিবার কখনও বাংলাদেশে যায়নি। কিন্তু ভারতের অনেক বাংলাভাষীর মতো তিনি ক্রমেই নিজেকে বহিরাগত বলে ভাবতে শুরু করেছেন। হয়রানীর ভয়ে কোথাও গেলে বাংলা বলতে ভয় পান বলে জানিয়েছেন তিনি।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ