বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সোমবার (১৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) রায় ঘোষণার প্রেক্ষিতে কলকাতার একটি স্থানে মিটিং করেছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। সেখান থেকে মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বাংলাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ‘আওয়ামী নেতাস ইন এক্সাইল প্লান স্টেয়ার ইন বাংলা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া এ খবর দিয়েছে। তবে কলকাতার কোথায়, কোন ঠিকানায় ওই মিটিং হয়েছে তা জানায়নি পত্রিকাটি।
সোমবার কেন্দ্রীয় কমিটির ওই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন দলটির এমন একজন সিনিয়র নেতা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় সম্পর্কে বলেছেন- ৫ই আগস্টের পর থেকে এটা নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা উন্মুখ হয়ে আছেন। তাই এ সময়ে তারা বিচারবিভাগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ওদিকে সোমবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আপডেট পাওয়ার জন্য খবরের চ্যানেল এবং নিউজ পোর্টালগুলোতে আঁঠার মতো লেগে ছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিকেল নাগাদ আদালতের রায় নিউজ চ্যানেল এবং অনলাইন নিউজ প্লাটফরমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ন্ত্রণে নিতে ঢাকায় শেখ হাসিনা প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আদালত তাকে অভিযুক্ত করে।
ওবায়দুল কাদের আদালতের রায়কে ‘একটি ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচারের নামে প্রহসন’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি আদালতের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দাবি করেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা অভিযোগে এই মামলা করা হয়েছে। তিনি রায়কে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এতে আমরা বিস্মিত নই। সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা এই বিচার ও রায়কে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখেন বলে বলা হয় রিপোর্টে।
তাতে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। এ জন্য তার বিরুদ্ধে এই প্রতিশোধ। কেন্দ্রীয় কমিটির ওই নেতা আরও বলেন, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে এবং তার পক্ষে আমরা যেসব আইনজীবীকে প্রস্তাব করেছিলাম তাদের কাউকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি না দেয়ার মাধ্যমে বিচার হয়েছে। তার আত্মরক্ষার অধিকার সমুন্নত রাখা হয়নি। এই নেতা আদালত গঠনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, শিগগিরই যমুনামুখী মার্চ করার জন্য আমরা আমাদের নেতার সঙ্গে আলোচনা করবো এবং তার অনুমতি চাইবো। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে এটা হবে অত্যন্ত কঠোর এক আন্দোলন।
টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয়: নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে ঝুঁকি
ওদিকে এই বিচার নিয়ে ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম- ‘গ্রে জাস্টিস: এডিটরিয়াল অন বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালস ডেথ সেন্টেন্স এগেইনস্ট ফরমার পিএম শেখ হাসিনা’। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রায় দেশটির একসময়কার শাসনব্যবস্থার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার ধরন, পূর্বনির্ধারিত বলেই মনে হওয়া রায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিক্রিয়া- এসবই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের ইতিমধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশকে আরও জটিল করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনাকে গত বছর তার সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত শত শত ছাত্র ও অন্যান্য বিরোধীদের হত্যার জন্য দায়ী করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে বিচার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি ভারতেই নির্বাসনে আছেন। শেখ হাসিনার কখনোই শক্তিশালী আইনি প্রতিনিধি দল ছিল না এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ও ছিল প্রায় অনুমেয়। মামলার গুণগত প্রমাণ যা-ই হোক না কেন, গোটা বিচারপ্রক্রিয়াটি একটি পূর্বনির্ধারিত ফলাফলসহ প্রদর্শনীমূলক বিচারের মতো দেখিয়েছে। পাশাপাশি রায় ঘোষণার পর সরকারের প্রতিক্রিয়াও হতাশাজনক। দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাশিতভাবেই ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। কিন্তু তারা অনুরোধের পাশাপাশি হুমকিও জুড়ে দিয়েছে: শেখ হাসিনাকে তৎক্ষণাৎ প্রত্যর্পণ না করলে ঢাকার পক্ষ থেকে তা ‘অবন্ধুসুলভ’ আচরণ হিসেবে দেখা হবে বলে সতর্ক করেছে।
ভারতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সংযত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারত বাংলাদেশের ‘মঙ্গলকামী’ এবং আলোচনার জন্য প্রস্তুত। তবুও ঢাকার কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই জানেন- ভারত যদি সত্যিই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়, তবে প্রকাশ্য বিবৃতি বা কঠোর ভাষার বদলে নীরব, আড়ালের কূটনীতি-ই তাদের সবচেয়ে কার্যকর সম্ভবত একমাত্র পথ। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কোনো একজন ব্যক্তিকে ঘিরে ফেলা ভুল। ভারত ও বাংলাদেশকে অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে কাজ করার পথ খুঁজে বের করতে হবে- এমনকি শেখ হাসিনার বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও। তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এই ভিন্নমতকে সামলে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতার ওপর।
শশী থারুর বললেন ‘উদ্বেগজনক’
ওদিকে ভারতের সিনিয়র কংগ্রেস নেতা শশী থারুর সোমবার বলেন, বাংলাদেশের অপসারিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ঘটনা ‘খুবই উদ্বেগজনক’। গত বছর আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি ভারত পালিয়ে যান। সোমবার বাংলাদেশে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে তার অনুপস্থিতিতে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এনডিটিভি বলেছে, শশী ঠারুর এ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে হোক বা বিদেশে, আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বাস করি না। তাই এই রায় আমাকে বিশেষভাবে হতাশ করেছে। কাউকে অনুপস্থিতিতে বিচার করা- যেখানে তিনি নিজেকে রক্ষা করার বা ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ পান না, তারপর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া…অন্য দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করা আমার জন্য সমুচিত নয়। কিন্তু এটুকু বলতে পারি- এটা কোনোভাবেই ইতিবাচক ঘটনা বলে মনে করি না। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, মানবজমিন থেকে নেয়া