দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আবারও বড় ধরনের ঝড় উঠেছে। এবার ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু নেপাল। সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। এটি দ্রুতই ভয়াবহ রূপ নেয়। অন্তত ২০ জন নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনে হামলা চালান এবং একাধিক রাজনীতিবিদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে।
অনেকের কাছে কাঠমান্ডুর এই দৃশ্য ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কা কিংবা ২০২৪ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের পুনরাবৃত্তিকে মনে করিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশেই গণবিক্ষোভ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পতন এবং রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থার এক ধরনের মিল পাওয়া যায়।
ভারতের বিশেষ দুশ্চিন্তা
নেপালের সংকট ভারতের জন্য শুধু প্রতিবেশীর অস্থিরতা নয়, বরং কৌশলগত দুশ্চিন্তার কারণ। নেপাল ভারতের একেবারে ঘনিষ্ঠ দেশ। ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনে দুই দেশ নিবিড়ভাবে যুক্ত।
নেপালের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ১,৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই সীমান্ত পাঁচটি ভারতীয় রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। এসব সীমান্ত পুরোপুরি উন্মুক্ত। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই এপার-ওপার যাতায়াত করেন। দুই দেশের মানুষ পারিবারিকভাবে সম্পর্কিত। এমনকি গ্রামীণ স্তরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনও তাঁদের মধ্যে গভীর।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপালের ঘটনাবলি নিয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ লিখেছেন, ‘নেপালের সহিংসতা হৃদয়বিদারক। বহু তরুণ প্রাণ হারিয়েছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ একই সঙ্গে তিনি নেপালের জনগণকে শান্তিপূর্ণ পথে এগোনোর আহ্বান জানান। পরে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নিয়ে তিনি জরুরি নিরাপত্তা বৈঠকও করেন।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেমন শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের গণ-অভ্যুত্থানে দিল্লি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিল, নেপালের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। বিশেষত, প্রধানমন্ত্রী পিকে শর্মা ওলির শিগগিরই দিল্লি সফরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন সব ভেস্তে গেল।
কৌশলগত হিসাব
ভারতের জন্য নেপালের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর দিকে চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি। দক্ষিণে নেপালের ভৌগোলিক পথ দিয়েই সরাসরি ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশ সম্ভব। তাই নেপাল শুধু প্রতিবেশী নয়, বরং ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত হিসাবের কেন্দ্রবিন্দু।
তা ছাড়া ভারতের ভেতরে বিপুলসংখ্যক নেপালি প্রবাসী রয়েছেন। সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ৩৫ লাখ। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। তাঁরা শ্রমবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশেষ চুক্তির আওতায় নেপালের প্রায় ৩২ হাজার গোর্খা সেনা বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন।
নেপাল হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবেও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিনাথ মন্দিরসহ বহু পবিত্র স্থানে প্রতিবছর হাজার হাজার ভারতীয় তীর্থযাত্রী ভ্রমণ করেন। অর্থনৈতিক দিক থেকেও নেপাল ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ভারতের সঙ্গে বার্ষিক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বেশির ভাগই নেপালের আমদানি—বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানি।
কূটনৈতিক জটিলতা
যদিও কাঠমান্ডুতে বুধবার থেকে কিছুটা শান্তি ফিরেছে, তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মূলে রয়েছে জনগণের গভীর ক্ষোভ। নেপালের তিন প্রধান রাজনৈতিক দল—ওলির নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস, এবং পুষ্প কমল দাহালের (প্রচণ্ড) নেতৃত্বাধীন মাওবাদী কেন্দ্র—সব কটির প্রতিই জনগণের আস্থা কমে গেছে। অথচ ভারতের সঙ্গে এই তিন দলেরই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিক্ষোভকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন নেতৃত্ব কে হবেন? যতক্ষণ না তা পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ দিল্লি কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সতর্ক থাকবে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়াল বলেছেন, ‘ভারত চাইবে না নেপালে বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি তৈরি হোক। তাই তারা সংযত ও সতর্ক পদক্ষেপ নেবে।’
এখানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গও উঠে আসে। দিল্লির সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। কিন্তু হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা শীতল। কারণ দিল্লি হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে।
ভারত-নেপালের সম্পর্কেও আগের টানাপোড়েন এখনো মীমাংসিত হয়নি। ২০১৯ সালে ভারত যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছিল, সেখানে নেপালের দাবি করা কিছু ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নেপাল পাল্টা নিজস্ব মানচিত্র প্রকাশ করে। সম্প্রতি ভারত ও চীন নেপালের দাবি করা লিপুলেখ গিরিপথ ব্যবহার করে সীমান্ত বাণিজ্য পুনরায় চালুর ঘোষণা দেয়। ওলি গত মাসে চীন সফরে গিয়ে এই বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন।
ভারতের করণীয়
এমন জটিল প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য করণীয় হলো একদিকে নেপালের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা, অন্যদিকে তরুণ জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করা। কারণ বিক্ষোভের মূল চালিকা শক্তি হলো তরুণেরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য ফেলোশিপ বাড়াতে পারে, কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারে, যাতে তরুণ প্রজন্ম ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক অনুভব করে।
কিন্তু ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কার্যত অচল হয়ে আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই খারাপ। বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক টানাপোড়েনের। মিয়ানমার ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে আছে। আর এখন নেপালের অস্থিরতা দিল্লির কূটনৈতিক বোঝা আরও বাড়াল।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা এই প্রেক্ষাপটে সতর্ক করে বলেছেন, ‘ভারত তার মহাশক্তি হওয়ার স্বপ্নে এতটাই মগ্ন যে কাছের প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে নজর দিতে ভুলে গেছে। অথচ মহাশক্তি হওয়ার প্রথম শর্ত হলো একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল প্রতিবেশ।’
নেপালের সাম্প্রতিক অস্থিরতা তাই শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি, আর ভারতের জন্য বিশেষ কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। দিল্লিকে এখন একদিকে প্রতিবেশী নেপালের নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ প্রশমিত করতে হবে। নইলে নেপালের মতো ছোট দেশেও ভারতের প্রভাব ক্ষয়ে যেতে পারে। আর সেটি হলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যে চীনকে এগিয়ে দেবে।
বিবিসি নিউজ