ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আহমেদাবাদ থেকে ২৪২ জন আরোহী নিয়ে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়া বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ২৯০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিমানের আরোহীদের পাশাপাশি দুর্ঘটনাস্থলে থাকা অনেকে নিহত হয়েছে। আরোহীদের একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বিমানটি অহমদাবাদ থেকে লন্ডন গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল।
আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (১২ জুন) দুপুরে অহমদাবাদের মেঘানিনগরের বিমানবন্দরের নিকটবর্তী ডাক্তারদের একটি হোস্টেল ভবনের উপর বিমানটি আছড়ে পড়ে। যার ফলে হোস্টেল এবং তার আশপাশেও অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভেঙে পড়ার পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় বিমানে। স্থানীয় হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা চলছে।
এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিমানে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন বিমানকর্মী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন পাইলট। এই বিমানে ১৬৯ জন ভারতীয় ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়া ছিলেন ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক, সাত জন পর্তুগিজ নাগরিক এবং এক জন কানাডার নাগরিক। ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছিল অহমদাবাদের পুলিশ, দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বিমানের ভেঙে পড়ার মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। অনেকেই ভেবেছিলেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ঘটনাস্থলে লাশের স্তূপ জমে গিয়েছে। মৃতদের অনেককে শনাক্তই করা যায়নি। লাশ শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেছে গুজরাত প্রশাসন। বিজে মেডিক্যাল কলেজে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা বিজয় রূপাণী অহমদাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিতে ছিলেন। লন্ডনে কন্যার কাছে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর সন্ধ্যায় নিশ্চিত করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিআর পাটিল।
অহমদাবাদের দুর্ঘটনায় এক জন মাত্র বেঁচে গিয়েছেন। বিমানটির ইকনমি ক্লাসের ১১এ আসনে বসেছিলেন ওই যাত্রী। নাম বিশ্বকুমার রমেশ। অহমদাবাদের পুলিশ কমিশনার জিএ মালিক সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানান, বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী রমেশই। পুলিশ তাঁকে খুঁজে পেয়েছে। আপাতত তিনি হাসপাতালে রয়েছেন।
ইতিমধ্যে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের একধিক ছবি এবং ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। যেগুলি দেখে বিমান দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন বিশেষজ্ঞেরা। ঘটনার পর প্রথম যে ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে, তাতে দেখা যায়, যাত্রা শুরুর পর লোকালয়ের উপর বেশ নীচ দিয়েই উড়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। কিছুটা এগোনোর পরেই তা আচমকা নীচের দিকে নামতে শুরু করে। তার পর একটি ভবনে ধাক্কা খেয়ে বিমানটি ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠে।
বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে, আগুনের শিখা আকাশের অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে যায়। এর পর সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে এসেছে বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। তাতে দেখা গিয়েছে, ওড়ার কিছু ক্ষণ পরেই বিমানটি বাঁ দিকে হেলে পড়তে থাকে। একই সঙ্গে বিমানের লেজের অংশটি নীচের দিকে নামতে থাকে।
বিশেষজ্ঞেরা প্রায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত, বিমান ভেঙে পড়ার আসল কারণ জানা যাবে ব্ল্যাকবক্সটি উদ্ধার করা গেলে। এই মুহূর্তে তাই দুর্ঘটনার নিশ্চিত কারণ বলা সম্ভব নয়। তবে কী ঘটে থাকতে পারে, বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় তেমন চারটি কারণ উঠে আসছে।
সম্ভাব্য চার কারণ
প্রথমত, এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হতে পারে বিমানটির ভার এবং সেই সংক্রান্ত গণনায় ত্রুটি। বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ওড়ার সময়ে যাত্রী, মালপত্র-সহ বিমানের ওজন কত হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রত্যেক বিমানের নির্দিষ্ট ভারবহন ক্ষমতা থাকে। কিন্তু অনেক সময়ে বিমান ওড়ার মুখে এই ওজনের হিসাবে গোলমাল করে ফেলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা। তখন বিমানটি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যে কোনও বিমানের আকার, গঠন অনুযায়ী তার ভারবহন ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। বিমানের মধ্যে যাত্রীদের কোথায় বসানো হবে, কোন দিকে কত যাত্রী বসলে বিমানের সামনের এবং পিছনের দিকের ভারসাম্য বজায় থাকবে, বিমান ওড়ার আগে তা হিসাব করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সেই হিসাবে ভুল হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। বিমান বিশেষজ্ঞ বন্দনা সিংহ জানিয়েছেন, বিমানটি যে ভবনে ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে তার একটি চাকা আটকে গিয়েছিল। ওজনের হিসাবে ভুল হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার। বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই মনে করছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি থাকতে পারে। হতে পারে, ল্যান্ডিং গিয়ারটি বিমান ওড়ার পর ঠিক মতো বন্ধ হয়নি। এই ল্যান্ডিং গিয়ারই বিমানের ভার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিমান ওঠানামার সময় রানওয়ের সংস্পর্শে আসে ল্যান্ডিং গিয়ার। এখান থেকে বিমানের চাকা বেরিয়ে আসে। ফলে বিমানের গতিও ল্যান্ডিং গিয়ারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে গোলমালের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তৃতীয় কারণ হিসাবে অনেকে বলছেন, মাটি ছাড়ার পরেই বিমানের উপরের দিকে ওঠার ক্ষমতা (লিফ্ট) কমে এসেছিল। একসময় এই ক্ষমতা একেবারেই শেষ হয়ে আসে। তখন বিমানটিকে আর ভাসিয়ে রাখতে পারেননি পাইলট। ভিডিয়ো দেখে অনেকে বলছেন, রানওয়ে ছাড়ার পর বিমানটি মাঝপথে সামান্য গোঁত্তা খেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। লিফ্ট কমে যাওয়ার কারণেই এমন ঘটেছে।
চতুর্থত, বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল। সেটি ভেঙে পড়ার আগে সর্বোচ্চ ৩২২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার গতিতে পৌঁছোতে পেরেছিল। যা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। ওই সময়ে বিমানের গতি আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। কোনও কারণে বিমানের ইঞ্জিন শক্তি হারিয়ে ফেলে। তার ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
কী ঘটে থাকতে পারে ককপিটে
বিমান অহমদাবাদের মাটি ছাড়ার পরপরই ‘মে ডে কল’ পাঠিয়েছিলেন পাইলট। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-কে পাঠানো সেই বিপদবার্তায় কাজ হয়নি। বিমানটির সঙ্গে এটিসি যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আর যোগাযোগ করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানটি প্রয়োজনীয় গতিতে পৌঁছোতে পারছে না দেখে, নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠতে পারছে না দেখে ককপিটে পাইলটেরা শেষ চেষ্টা করেছিলেন। হাতল টেনে ধরে বিমানটির নাকের অংশ তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
সময় পাননি পাইলট
মাটি থেকে ৬২৫ ফুট মাত্র উঠতে পেরেছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। সেখান থেকেই এটিসি-কে পাঠানো হয়েছিল বিপদবার্তা। ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি মিনিটে ৪০০ ফুট গতিতে নীচে নেমে আসছিল। তার পরেই লোকালয়ে ভেঙে পড়ে। পাইলটের হাতে এক মিনিটও সময় ছিল না।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যদি বিমান ৩৫ হাজার ফুট উপরে থাকত, তা হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় পেতেন পাইলট এবং ক্রু সদস্যেরা। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি।
দুঃস্বপ্নের ড্রিমলাইনার!
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১-র ভেঙে পড়া ভারতের উড়ান-ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ দুর্ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়েছে। বিমানটি আমেরিকার বোয়িং সংস্থার তৈরি ‘৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার’ শ্রেণির। এই প্রথম বার বড় দুর্ঘটনায় পড়ল ড্রিমলাইনার। তবে অতীতে এই মডেলটির ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’ একাধিক বার আলোচনায় এসেছে। এই মডেলটির উড়ান শুরু হয়েছিল ১৮ বছর আগে, ২০০৭ সালে।
ভেঙে পড়া ড্রিমলাইনারটিও প্রায় ১২ বছরের পুরনো। বাজারে আনার সময় বোয়িং দাবি করেছিল, তৈরি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার পৃথিবীর নিরাপদতম বিমান। কিন্তু ২০০৯ সালে প্রথম দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। মাঝ আকাশে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আপৎকালীন অবতরণে বাধ্য হয়েছিল। অহমদাবাদে এই মডেলের বিমানের ষষ্ঠ দুর্ঘটনা ঘটল।
ছাত্রাবাস বিপর্যয়
বিমানবন্দরের অদূরে বিজে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের উপর ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পাঁচ জন ডাক্তারি পড়ুয়ার মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আহত আরও অনেকে। প্রাণে বাঁচার জন্য তিনতলার বারান্দা থেকে ঝাঁপও দিয়েছেন এক জন। ঘটনার পরের কিছু ছবিতে হস্টেলের ক্যান্টিনের, যেখানে আবাসিকেরা খাবার খান, বিধ্বস্ত চিত্র দেখা যাচ্ছে। দেখা গিয়েছে, বহু বেঞ্চ ভেঙে পড়ে রয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে থালায় সাজানো খাবার। মেস তছনছ হয়ে গিয়েছে। ভেঙে পড়েছে দেওয়ালও। অনেকেই সেই সময়ে খাচ্ছিলেন।