ভারতের করুণ নিরাপত্তা রেকর্ড: ৩ দশকে ৫৩৪ বিমান ধ্বংস, ১৫২ পাইলটের মৃত্যু

ভারতের করুণ নিরাপত্তা রেকর্ড: ৩ দশকে ৫৩৪ বিমান ধ্বংস, ১৫২ পাইলটের মৃত্যু
ছবি: প্রতীকী

গত ৩০ বছরে ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) যুদ্ধবিমান, প্রশিক্ষণ, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমানসহ ৫৩৪টি এয়ারক্রাফট হারিয়েছে। যা বিশ্বব্যাপী সামরিক মানদণ্ডে সবচেয়ে ভয়াবহ নিরাপত্তা রেকর্ড।

ভারতের সংসদীয় আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত প্রশ্নোত্তর সংকলন করে এই বিস্ময়কর পরিসংখ্যান বের করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অঞ্চিত গুপ্ত। এই সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ১৫২ জন পাইলট প্রাণ হারিয়েছেন, যা একবিংশ শতাব্দীতে ‘পুরনো’ জেট উড়ানোর প্রকৃত ব্যয়ের গুরুতর প্রমাণ। এর জন্য দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সুপারসনিক ফাইটার মিগ-২১-এর দায় সবচেয়ে বেশি। সবাই একে এখন “উড়ন্ত কফিন” নামে চেনে।

গুপ্ত জানান, সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল ১৯৯০-এর দশক। তখন আএএফ নিয়মিতভাবে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০টি বিমান হারাত, যার সিংহভাগই ছিল কুখ্যাত মিগ-২১ বাইসন।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাইলটদের “উড়ন্ত কফিন”-এ চড়তে হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ নিরাপত্তা রেকর্ড সত্ত্বেও মিগ-২১ এখনো আইএএফের সার্ভিসে রয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৯ সালের দিকে দ্বিতীয় প্রজন্মের ইন্টারসেপ্টর হিসেবে মিগ-২১ ডিজাইন করে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে আইএএফ এই বিমান সংগ্রহ করে। শীতল যুদ্ধের সময় এগুলো ভারতকে প্রয়োজনীয় সুপারসনিক বিমান কভারেজ দেয়।

পরে ভারত কিছু এয়ারফ্রেম বাইসন ভেরিয়েন্টে রূপান্তর করে। এতে ইসরায়েলি রাডার, নতুন ক্ষেপণাস্ত্র এবং উন্নত ইলেকট্রনিক যুদ্ধক্ষমতা যোগ করা করা হয়। কিন্তু এই আধুনিকতার ছোঁয়া কখনও মিগ-২১-এর মৌলিক দুর্বলতা কাটাতে পারেনি। এখনো ৬০ বছরের পুরানো ফিউজলেজ বহন করে চলেছে এই বিমান।

খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতি, নড়বড়ে কাঠামো এবং দুর্বল সুরক্ষা পাইলটদের বিপদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের অনেককেই এখনও সু-৩০এমকেআই এবং রাফালের মতো ফ্রন্টলাইন প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে মিগ-২১ চালানো শিখতে হয়।

বর্তমানে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ২০ থেকে ৩০টি মিগ-২১ বাইসন কার্যকর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর সবকটি ছয় দশকের পুরনো।

মাত্র কয়েকদিন আগে রাজস্থানের চুরু জেলার ধানক্ষেতে একটি জাগুয়ার ট্রেনার বিধ্বস্ত হলে দুই পাইলট নিহত হন।

সর্বশেষ দুর্ঘটনা ছিল এ বছরের তৃতীয় জাগুয়ার দুর্ঘটনা। এর আগে মার্চে আম্বালায় এবং এপ্রিলে জামনগরে দুটি জাগুয়ার দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটেছে পুরনো বিমানের কারণে।

গ্লোবাল এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের হিসাবে গত দশকে কমপক্ষে ১২টি জাগুয়ার হারিয়েছে আইএএফ। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে উড়তে থাকা একটি প্ল্যাটফর্মের জন্য এটি একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান।

১৯৭৯ সালে ভারত জাগুয়ার প্রকল্প চালু করে। এখনো এটি দূরপাল্লার আক্রমণ এবং পারমাণবিক সরবরাহ ক্ষমতার মূল স্তম্ভ হিসেবে রয়ে গেছে। অথচ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ওমান, ইকুয়েডর এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো অনেক আগেই তাদের জাগুয়ার অবসরে পাঠিয়েছে। সেগুলো এখন বিমান জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। একমাত্র ভারতই সক্রিয় জাগুয়ার বহরের অপারেটর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

কেন?

কারণ ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সংগ্রহ বারবার হোঁচট খেয়েছে।

মিগ-২১ বাইসন ও জাগুয়ার প্রতিস্থাপনের জন্য স্থানীয়ভাবে তেজাস এমকে-২ তৈরির প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ার কারণে আইএএফ পরিকল্পনাকারীদের কাছে এখন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তেমন একটা নেই।

আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতা ও রাজনৈতিক বাধা মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট প্রোগ্রামের অগ্রগতি ধীর করে দিয়েছে। ১১৪টি নতুন যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বিশাল ক্রয় পরিকল্পনা প্রস্তাব পর্যায়ে আটকে আছে।

২০২৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)-এর মিলিটারি ব্যালেন্স শিটে দেখা যায়, আইএএফ এখনও প্রায় ১১৫টি জাগুয়ার পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ২৮টি প্রশিক্ষণ কাজে, ৭৯টি একক-সিটের আক্রমণ চালাতে এবং ৮টি সামুদ্রিক স্ট্রাইক বিমান।

প্রতিবেশী চীন যখন দ্রুত তার পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বহর সম্প্রসারণ করছে এবং পাকিস্তান তাদের নিজস্ব জেএফ-১৭ ও জে-১০সি বিমানকে পিএল-১৫ এর মতো উন্নত বিভিআর ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আপগ্রেড করছে, তখন শীতল যুদ্ধ যুগের জেটের উপর ভারতের নির্ভরতা কেবল নিরাপত্তা ঝুঁকিই নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক বিমান ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত দায়।

ভারত এরপরও জাগুয়ারের আয়ু বাড়াতে লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে চলেছে। দেশটির এই দুর্বলতা প্রতিবেশীদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কারণ নেই।