২০২১ সালের আগস্টে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর থেকে তালেবান কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি বিচক্ষণ কৌশল অবলম্বন করে আসছে। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তালেবান এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। তবে নতুন যে স্বাভাবিকতা জন্ম নিয়েছে তা থেকে তালেবান সরকার ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) মস্কোতে শেষ হওয়া ৩ দিনব্যাপী ‘১৩তম আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে’ প্রথমবারের মতো তালেবান সরকারের একটি প্রতিনিধি অংশ নেয়। ২০১০ সাল থেকে রাশিয়া প্রতিবছর এই সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে। এবারের সম্মেলনে গ্লোবাল সাউথ অ্যান্ড ইস্ট, কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস (সিআইএস), কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও), ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সদস্যসহ ১০৪টি দেশ ও ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থার ১২৬টি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়।
এতে বুঝা যায়, তালেবান সরকার আঞ্চলিক অনেক রাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতোমধ্যে ‘কার্যত স্বীকৃতি’ আদায় করতে পেরেছে।
বৈধতা আদায়ের ক্ষেত্রে তালেবানের এই অগ্রযাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছে ইউরেশিয়া রিভিউ জার্নাল। এতে বলা হয়, এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশ তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। এটা অনেকটা ইচ্ছা করেই। তালেবান সরকার লিঙ্গ বৈষম্য নিরসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা (বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের অধিকার) দেখানোর মতো ইস্যুগুলো এখনো বিবেচনায় নিতে পারেনি। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন এবং আফগান মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদের অঙ্গীকার পূরণ করতে পারেনি। এরপরও বাস্তব পরিস্থিতি কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে তালেবানদের কাছে টানার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে চীনসহ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কাবুল সরকারের সাথে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
তালেবানদের সাথে চীন, রাশিয়া, ইরান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জড়িত হওয়ার পেছনে রয়েছে নিরাপত্তা উদ্বেগ, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পশ্চিমা প্রত্যাহারের ফলে তৈরি শূন্যতা পূরণের আকাঙ্ক্ষার জটিল মিশ্রণ। বাস্তবতার কাছে নৈতিক আপত্তি এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক নিয়ম চাপা পড়ে গেছে।
আমরা তালেবানদের অতীত রেকর্ডের দিকে তাকালে দেখব যে সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে এখনো প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ রয়ে গেছে। তালেবান আন্দোলন রাজনৈতিক মূলধারায় যোগ দিয়েছে কিন্তু দেশটির অনেক গোষ্ঠী এখনো নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান (আইএস-কে)-কে তালেবানরা এখনো পুরোপুরি দামাতে পারেনি। এই গোষ্ঠী প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি তৈরি করে চলেছে।
আফগানিস্তান বিষয়ক রাশিয়ার বিশেষ দূত জমির কাবুলভ বলেন, আইএস-কে হলো ’অভিন্ন শত্রু’; এদের দমনে তালেবানরা চাইলে সহযোগিতা দেয়া হবে। রাশিয়া সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে তালেবানকে বাদ দিতে চায়। এটা তালেবানের সঙ্গে মস্কোর পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত।
তালেবান শাসকদের নিয়ে আগে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তানের মতো মধ্য এশীয়ার দেশগুলো বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে। তারা এখন নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে। দেশগুলো বুঝতে পেরেছে যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ইত্যাদির মতো আন্ত:সীমান্ত নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসন এবং আফগানিস্তানে সম্ভাব্য অস্থিরতার প্রভাব যেন তাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাবুলের ‘কার্যত শাসক গোষ্ঠীকে’ মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তাজিকিস্তানও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কাবুলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বজায় রেখেছে।
মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী ট্রানজিট হাব হিসেবে আফগানিস্তানের ভূ-কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মার্কিন বাহিনী বিদায়ের এক মাসের মাথায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে উজবেকিস্তান একটি তালেবান প্রতিনিধিদলকে সফরের আমন্ত্রণ জানায়। ওই সফরে দুই পক্ষ নিরাপত্তা ও বাণিজ্য প্রোটোকল স্বাক্ষর করে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ট্রান্স-আফগান রেলপথ নির্মাণ। তালেবানদের সাথে কাজাখস্তানের বাণিজ্যিক চুক্তির পরিমাণ ২০২৩ সাল নাগাদ ১.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হয়। আফগানিস্তানের প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয় তুর্কমেনিস্তান। টাপি (তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া) গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের আলোচনা পুনরায় শুরু হয়। রাজনৈতিক ও আর্থিক বাধার কারণে এই পাইপলাইনের অগ্রগতি তেমন না হলেও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ট্রানজিট থেকে রাজস্ব আয়ের জন্য তালেবান সরকার সক্রিয়ভাবে এই ধরনের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে চায়।
মার্কিন প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে নিরাপত্তার ঘাটতি পূরণ ও মূলবান খনিজ সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে চীন সতর্কতার সাথে তালেবান শাসকদের কাছে টানতে থাকে। আফগানিস্তানে চীনের আগ্রহ বহুমুখী – সম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে আফগানিস্তানকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর সাথে যুক্ত করা এবং সীমান্তবর্তী জিনজিয়াং প্রদেশে চরমপন্থার বিস্তার রোধ করা।
চীন প্রথম দেশ যে কিনা তালেবানদের দূতাবাস খোলার অনুমতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা একজন আফগান দূতের নিয়োগও অনুমোদন করেছে।
এমনকি তালেবানদের নিয়ে সদা শঙ্কিত ভারতও কাবুলের সাথে যোগাযোগ বাড়তে ‘ধাপে ধাপে’ অগ্রসর হচ্ছে। ২০২১ সালের আগস্টে দোহায় একজন সিনিয়র তালেবান নেতার সাথে কাতারে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের মধ্য দিয়ে এই যোগাযোগ শুরু হয়। পরের বছর জুনে একটি ভারতীয় প্রতিনিধিদল কাবুল সফর করে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ভারতের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকতা তালেবান কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। গত জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি দুবাইয়ে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সবশেষ গত মে মাসে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর মুত্তাকির সাথে প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কূটনীতির ক্ষেত্রে দেশটি সূক্ষ্মভাবে কাতারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। চীনের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে তারা তালেবান সরকারকে দূতাবাস খোলার অনুমতি দিয়েছে এবং রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আফগানিস্তানের তিনটি প্রধান বিমানবন্দর পরিচালনার কাজ পেয়েছে। এগুলোকে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি যোগাযোগ চ্যানেলগুলো বজায় রাখার কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও তালেবান শাসনের সাথে ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বর্তমান কাবুল সরকারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার বৈধতা প্রদান করে। প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে এই “কর্ম-স্তরের” সম্পর্ক তালেবান সরকারকে নানাভাবে লাভবান করছে। নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ জব্দের কারণে তালেবান তীব্র আর্থিক সংকটের মুখোমুখি। তাই তারা অ-পশ্চিমা অংশীদারদের কাছ থেকে বিনিয়োগ এবং সমর্থন আদায় করতে তাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে জোড়ালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে বৈধতা পেতে তালেবান শাসনব্যবস্থাকে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বেগ নিরসন করতে হবে। আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের কাছে স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক লাভ অগ্রাধিকার পেলেও নারী ও মেয়েদের অধিকারের মতো ইস্যুগুলো বিশ্বের অন্যান্য অংশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
এই সময়ে এসে আমরা বলতে পারি যে তালেবান শাসনব্যবস্থা আঞ্চলিক পর্যায়ে এক ধরনের বৈধতা অর্জন করেছে। পশ্চিমারা মানবাধিকার প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানে নৈরাজ্য ও মানবিক সংকট রোধ করার জন্য সীমিত আকারে হলেও বাস্তববাদী সম্পৃক্ততার প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত হতে তালেবান শাসনব্যবস্থার বৈধতা প্রয়োজন। তবে এটা নির্ভর করবে তারা আন্তর্জাতিক নিয়ম কাঠামোর মধ্যে কীভাবে একীভূত হতে ইচ্ছুক, তার উপর।
গত কয়েক বছরে তারা ভূ-রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ স্বীকৃতি পেতে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আপাতত পশ্চিমা বিশ্ব না হোক এর বিপরীতে যেসব দেশ রয়েছে তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে পারাটাই কম কিসে।