বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নে বারবার বাধা দিয়েছে ভারত

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়নে বারবার বাধা দিয়েছে ভারত
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান এফটি-৭বিজেআই। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ যখনই তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিমানবাহিনী আধুনিকীকরণের চেষ্টা করেছে তখনই এক অযাচিত বাধার সম্মুখিন হয়। আর এই বাধা আসে প্রতিবেশী বড় দেশটির তরফ থেকে। নয়াদিল্লি প্রায়শই এমন কৌশলগত, আমলাতান্ত্রিক বা কূটনৈতিক বাধা তৈরি করে যা ঢাকার প্রচেষ্টাকে ধীর বা দুর্বল করে দেয়। কিন্তু কেন?

এর জবাব রয়েছে আঞ্চলিক কৌশলগত হিসাব, প্রতিরক্ষা শিল্প সক্ষমতার ব্যবধান এবং বিশেষ করে চীনকে নিয়ে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার জটিল মিশ্রণের মধ্যে।

দক্ষিণ এশীয়া অঞ্চলে, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর মাধ্যমে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে ভারত গভীর উদ্বিগ্ন। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান, তিন দিকে অভিন্ন স্থল সীমান্ত এবং ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে ভারত প্রায়শই দেশটিকে তার গতানুগতিক প্রভাব বলয়ের অংশ মনে করে।

ভারতের কল্পিত এই প্রভাব বলয় বাংলাদেশীদের কাছে “ভারতীয় আধিপত্যবাদ” হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

ঢাকা যখনই চীন থেকে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি – যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র বা রাডার সিস্টেম – সংগ্রহ করে, তখনই সেটা নয়াদিল্লির উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ভারত কখনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব করেনি। ভারত থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা এবং প্রস্তাব থাকলেও আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।

ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাত এখনও ক্রান্তিকাল পার করতে পারেনি। তারা নির্ভরযোগ্যতা, সাশ্রয়ী মূল্য এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন বা পশ্চিমা শক্তির মতো বৈশ্বিক জায়ান্টদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।

অন্যদিকে, জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঢাকায় দিল্লিপন্থী শাসন পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ চলতি বছরের শুরুতে ভারতের সাথে ২১ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করে বলেছে যে এটি ছিল পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকারের করা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চুক্তি।

তাই বাংলাদেশের কাছে তেমন কার্যকর বিকল্প না থাকায় তারা প্রতিরক্ষা প্রয়োজন পূরণের জন্য চীন এবং রাশিয়ার দিকে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে চীন বাংলাদেশের প্রধান প্রতিরক্ষা মিত্র হয়ে উঠেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী চীনা অস্ত্র রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাহক (১১ শতাংশ) ছিল বাংলাদেশ। এটা হয়েছে ভারতপন্থী হিসাবে পরিচিত সাবেক শাসনামলে। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে চীন থেকে দুটি মিং-শ্রেণীর সাবমেরিন কেনে। তখন থেকে ভারত ঢাকার সামরিক কেনাকাটার উপর নজরদারি জোরদার করে।

ঢাকা যখন উন্নত যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করে তখন ভারতীয় বাধা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ প্রথমে ভারতের তৈরি তেজাস বিমানের কথা ভাবলেও প্রতিযোগিতামূলক শর্ত দিতে নয়াদিল্লির দোটানা মনোভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান প্রশিক্ষণ বিমান ইয়াক-১৩০ এবং চীনা জেএফ-১৭ বিমান বেছে নিতে বাধ্য হয়।

এটি কোনও নতুন ঘটনা নয়। চীনা ফ্রিগেট, চীনা সাবমেরিন বা তুর্কি ড্রোন কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশ যখনই তার নৌশক্তি বাড়ানো শুরু করে তখনই ভারত হয় ব্যাক চ্যানেল কূটনীতির মাধ্যমে আপত্তি প্রকাশ করেছে অথবা আঞ্চলিক ফোরাম এবং দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করেছে। তাছাড়া, এই ধরনের ক্রয়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়া প্রায়শই শোরগোল তোলে যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা “সামরিক অবস্থান” সুসংহত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বৈধ নিরাপত্তা চাহিদা পূরণের জন্য যে এসব কেনাকাটা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা কিছু বলে না।

বাস্তবে আমরা দেখি, ভারত বাংলাদেশে চীনা সামরিক সরঞ্জাম প্রবেশ করতে যত বেশি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ঢাকা তত বেশি বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এতে ভারতের কৌশলগত অস্বস্তি আরও বৃদ্ধি পায়।

ভারতের সীমাবদ্ধতা

এটা ভারতের এক ধরনের দ্বিমুখী নীতি। একদিকে তারা বাংলাদেশে চীনা সামরিক প্রভাব প্রতিহত করতে চায় কিন্তু নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না। ভারতকে প্রায়শই সহযোগিতার চেয়ে প্রতিরোধে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়।

ভারত আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা রপ্তানিকারক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বড় বাধা। তার প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা এবং হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড বেশ কিছু পণ্য উৎপাদন করলেও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ অস্ত্র-সরঞ্জাম আমদানি করা যেমন, রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছ এস-৪০০, ইসরায়েল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বারাক-8। ভারত নিজের সামরিক বাহিনীকে দেশীয় প্রযুক্তি সরবরাহ করতে না পারলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতকে আধুনিকীকরণের জন্য অংশীদার হবে কীভাবে?

বাংলাদেশ আর অপেক্ষা করতে পারছে না। কারণ দেশটি ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে: সমুদ্র জলদস্যুতা, আকাশসীমা লঙ্ঘন, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কৌশলগত চাপ। বাংলাদেশের জন্য প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণ একটি জরুরি প্রয়োজন।

দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন প্রয়োজন

ভারতকে হুমকি দিতে নয় বরং বঙ্গোপসাগরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পাশাপাশি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণের মধ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ চায়। ঢাকা তার ঐতিহ্যবাহী পররাষ্ট্র নীতি কাঠামোর মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়। ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই সম্পর্ক বজায় রাখছে বাংলাদেশ। একই সাথে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথেও তার প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে সক্রিয়ভাবে বৈচিত্র্যময় করছে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণে অনানুষ্ঠানিক বাধা তৈরি করে ভারত দেশটিকে অন্যান্য প্রধান ও আঞ্চলিক শক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সত্যিকারের স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া অর্জনের জন্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চাহিদার প্রতি ভারতকে আরও সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। ঢাকার সামরিক আধুনিকীকরণকে নয়াদিল্লির সন্দেহের চোখে দেখা উচিত নয়।

বিপরীতে, ভারত যদি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা স্বায়ত্তশাসনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে, তাহলে তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করতে ব্যর্থ হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক বিভেদ আরও তীব্র হবে। পরিণামে অন্যান্য প্রধান এবং আঞ্চলিক শক্তি সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসার সুযোগ পাবে। তখন ভারতের হাতে আর কোন সমাধান থাকবে না।

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ