দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন টিকিয়ে রাখতে ভারতের ভূমিকা দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার চেয়ে স্বল্পমেয়াদী কৌশলগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার বিপদের একটি কঠিন পাঠ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার পর এমন একটি শাসনব্যবস্থা সমর্থন করার জন্য ভারতকে তার অপরাধের জন্য অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। এটা ছিল এমন এক শাসনামল যা একটি জাতির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশের এই হারানো দশকের বীজ প্রথম বপন করা হয়েছিল ২০১৩ সালে, ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগের এই সফরে তিনি জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে এমন এক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজি করান যা সব প্রধান বিরোধী দল বর্জন করেছিল।
অর্থপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনে একটি ডামি বিরোধী দল গড়ে তোলার এই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের হারানো দশকের সূচনা করে। যা ভারতীয় সমর্থনে দেশটির ভঙ্গুর অথচ কার্যকরী গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদে পরিণত করেছিল।
অনেক বাংলাদেশীর জন্য এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত–যখন ভারত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে একটি দলের পাশে থাকা বেছে নেয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের কারচুপির নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। তবুও ভারত হাসিনার একমাত্র সমর্থক হিসাবে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে, তার সরকারকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দিয়েছে,যা হাসিনার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বাচনী জালিয়াতির বিষয়ে নীরবতার পাশাপাশি এই অটল সমর্থন, একনায়কতন্ত্র লালনকারী হিসাবে ভারতের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করেছে। ভারতের সমর্থন না পেলে হাসিনা ক্ষমতায় টিকতে পারতেন না।
শোষণের দশক
হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন পরার্থবাদী ছিল না। তার পুরো মেয়াদ জুড়ে, ট্রানজিট রুট থেকে জ্বালানি রপ্তানি পর্যন্ত, প্রধান চুক্তিগুলো ভারতীয় স্বার্থের পক্ষে ছিল। এসব চুক্তির প্রায় সবগুলোই বাস্তবায়ন করা হয় বাংলাদেশের অর্থ ব্যয় করে।
এই চুক্তিগুলোকে অনেকে বিবেচনা করেন রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ভারতকে হাসিনার “প্রতিদান” হিসাবে। এতে হাসিনা নিজের জনগণের চেয়ে ভারতীয় স্বার্থ বেশি দেখেন বলে মতটিকে আরও সুদৃঢ় হয়। হাসিনা বাংলাদেশকে সিকিমের মতো ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করছেন বলে সন্দেহ তৈরি হয়। এতে হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা আরও ক্ষয়ে যায়।
এই উপলব্ধি বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। শেখ হাসিনার সরকার ভারতের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়লেও, সাধারণ বাংলাদেশিরা এই সম্পর্ককে শোষণমূলক হিসেবে দেখে। আওয়ামী লীগের শাসন শুধু ঘরে নিপীড়নমুলক নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরাধীনতার সমার্থক হয়ে ওঠে।
তবুও, এটি যে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে তার প্রতি ভারতকে এখনো অতিমাত্রায় উদাসীন বলে মনে হচ্ছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্ককে হাসিনার চোখ দিয়ে দেখে আসছেন। তারা বাংলাদেশের জনগণের সাথে অর্থপূর্ণভাবে জড়িত হতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ভারতের ভুল পদক্ষেপগুলো তার মিডিয়া প্রচারণা আরো জটিল করে তোলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিকৃত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভারতীয় মিডিয়া।
রিউমার স্ক্যানার সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখায় কীভাবে ৪৯টি ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট বাংলাদেশ সম্পর্কে ১৩টি মিথ্যা গল্প ছড়িয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলো দেশটির গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে ইসলামি বিপ্লব হিসাবে চিত্রায়িত করে।
সবচেয়ে নগ্ন উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি ছিল হাসিনা-খেদাও বিদ্রোহ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার কভারেজ। ফার্স্টপোস্ট এবং দ্য ইকোনমিক টাইমসের মতো আউটলেটগুলো ভিত্তিহীন দাবি করে যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং চীন ভারত-বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
এই ধরনের প্রচারণা শুধুমাত্র মিডিয়া আউটলেটে সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গুজবের কোরাসে যোগ দিয়ে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য জাতিসংঘ বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানান – এমন বক্তব্য উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নিপীড়ক যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে ভারত হিন্দু নিপীড়ন বলে প্রচারণা চালায়। অথচ এর শিকড় যে ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষোভের মধ্যে নিহিত সে বিষয়টি তারা উপেক্ষা করে।
অভ্যুত্থানকে একটি সাম্প্রদায়িক বয়ানে পরিণত করার মাধ্যমে, ভারত বাংলাদেশের সংগ্রামকে বিকৃত করেছে, যা দেশটির জনগণকে আরও ক্ষুব্ধ করে। তারা ভারতের এই আচরণকে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আড়ালে একটি পতিত শাসনকে রক্ষার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছে।
ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে প্রচারের পাশাপাশি আগরতলায় বাংলাদেশি হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব আরও গভীর করেছে।
এসব বয়ান বিদ্রোহের গণতান্ত্রিক চেতনাকে উপেক্ষা করে একে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসাবে চিত্রিত করে। এই ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে ভারতীয় মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশী জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
আস্থা পুনরুদ্ধার
হাসিনার কর্তৃত্ববাদ থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসার এই সময়ে, ভারত কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি: অতীতের নীতি বজায় রাখা বা একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় এমনভাবে নীতিগুলো ঢেলে সাজানো। পরেরটির জন্য নয়াদিল্লিকে তার এনগেজমেন্ট কৌশলে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।
শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার খায়েশ পরিত্যাগ করতে হবে: আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভারতকে অবশ্যই তার মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। হাসিনার প্রত্যাবর্তন বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। পরিবর্তে, ভারতের উচিত বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সাথে কাজ করা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয় এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে মনযোগী হওয়া।
নিপীড়নের দশকে নিজের দায় মেনে নিতে হবে: ভারতের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই হাসিনার দমনমূলক শাসন টিকিয়ে রাখতে তাদের ভূমিকা স্বীকার করতে হবে। এটি নিছক আত্মদর্শনের একটি অনুশীলন নয় বরং আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনাকে সমর্থন করে ভারত এমন একটি জাতির গলা টিপে ধরেছিল, যারা ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে। ভারত সক্রিয়ভাবে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না করলে গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতা বাংলাদেশীরা ভুলে যাবে না।
অংশীদারিত্বে ন্যায্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে: হাসিনার সরকারের সাথে ভারতের চুক্তিগুলোকে বাংলাদেশীরা ব্যাপকভাবে শোষণমূলক বলে মনে করে, যা বাংলাদেশের টাকায় ভারতকে উপকৃত করছে। সামনের দিকে অগ্রসর হতে, নয়া দিল্লীকে অবশ্যই উভয় দেশের স্বার্থের জন্য ন্যায়সঙ্গত চুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, জ্বালানী ও ট্রানজিট নিয়ে স্বচ্ছ আলোচনা; যা শক্তির ভারসাম্যহীনতার পরিবর্তে প্রকৃত অংশীদারিত্বকে প্রতিফলিত করবে।
গুজব ও সাম্প্রদায়িক বয়ানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে: ভারতীয় মিডিয়াকে অবশ্যই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্যের নিয়মতান্ত্রিক প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশীদের সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক বা ইসলামি হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত না করে গণতান্ত্রিক চেতনাকে স্বীকৃতি দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করার সময় অবশ্যই সাম্প্রদায়িক চশমা দিয়ে তাকানো বন্ধ করতে হবে।
হাসিনা মোহ থেকে বেরিয়ে আসা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ’হাসিনা মোহে’ আটকে থাকতে পারে না।
ভারতকে অবশ্যই এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার ভূমিকার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, যা গণতন্ত্রকে দমিয়ে রেখেছিল এবং এর জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের লড়াই দীর্ঘ ও কঠিন। স্বৈরাচারের ছায়া থেকে বের হয়ে বাংলাদেশীরা এখন সহযোগী চায়, প্রভু নয়। সমতা, সম্মান এবং অভিন্ন আকাঙ্খা সম্বলিত সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের জন্য এটি একটি সুযোগ।
কিন্তু নয়াদিল্লি পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হলে এবং একটি নতুন জাতীয় পরিচয় গঠনে বাংলাদেশের উত্তরণের এই সময়ে উস্কানি দিতে থাকলে এখানে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি হবে – যার একমাত্র লক্ষ্য হবে ভারতের বিরোধিতা করা।
তাই ভারতের সামনে পথগুলো স্পষ্ট: আস্থা বিনির্মাণ এবং একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করুন অথবা হারিয়ে যাওয়া দশকের মোহে আচ্ছন্ন থাকুন।
এশিয়া টাইমস, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ