বাংলাদেশের সাথে ‘নতুন অধ্যায়’ শুরুর সুযোগ এসেছে পাকিস্তানের

বাংলাদেশের সাথে ‘নতুন অধ্যায়’ শুরুর সুযোগ এসেছে পাকিস্তানের
করাচির বিখ্যাত মুসা কলোনি। এখানকার 'বাঙালি পাড়া'য় ব্যবসায়ীরা সী-ফুডের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এই এলাকার পুরো ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেন একসময়ের 'পূর্ব পাকিস্তান’ বর্তমানের বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীরা। ছবি: সংগৃহীত

ভাসানী সুইটস থেকে বাংলা বাজারে পৌঁছাতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে। এরপর ঢাকা ফেব্রিক্সে গিয়ে একটি ‘ঘামছা’ বা ‘লুঙ্গি’ কিনে আপনার প্রয়োজন মতো কোনো কীটনাশক কিনতে চিটাগং কেমিক্যালসেও ঘুরে আসতে পারেন।

মাত্র আধা ঘন্টায় আপনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, খুলনা, রংপুর বা নারায়ণগঞ্জের প্রাণবন্ত সড়কগুলো দাপিয়ে বেড়ানোর উত্তেজনা অনুভব করবেন। এর সবকিছুই করাচি শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ওরাঙ্গি টাউনে নিজস্ব প্রচেষ্টায় সুপ্রতিষ্ঠিত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মালিকদের ব্যক্তিগত শেকড়ের সঙ্গে গভীর সংযোগের জানান দেয়।

প্রতিটি গল্পই অনন্য, যার অধিকাংশ ১৯৭১ সালের যুদ্ধ বা পাকিস্তানের সরকারি বর্ণনায় ‘ঢাকার পতনের’ স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। এরা এখনো জন্মস্থানকে নিয়ে স্মৃতিকাতর, যাকে তারা হারানো স্বদেশ মনে করে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সেই সময়ের অগণিত কাহিনী বন্দরনগরীর লোকের মুখে মুখে। যার জেরে অনেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল।

এ মাসেই বাংলাদেশ তার বিজয়ের ৫৩তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে, যা ইতিহাসের এই অধ্যায়কে দীর্ঘকাল ধরে সংজ্ঞায়িত করা কিছু শোক মুছে দিয়েছে, যার সঙ্গে মিছে আছে কিছু সতর্ক আশাবাদ। আগস্টে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন অনেক পাকিস্তানি, বিশেষ করে যারা এখনও বাংলাদেশ এবং এর সাথে গভীর, ব্যক্তিগত সংযোগ অনুভব করেন, তাদের মনে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে।

শামীম আক্তার এবং তার পরিবার ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি ওরাঙ্গি টাউনের সাড়ে ১১ সেক্টরে বসতি স্থাপন করে। ১৯৭১ সালে তারা কীভাবে জীবন নিয়ে পালিয়ে পাকিস্তানে পৌঁছাতে পেরেছিল সেটা এক হৃদয়বিদারক কাহিনী। এখন শুধুমাত্র একটি জিনিস তাদের অতীতের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। ১৯৮৭ সালের পর আগামী মাসে তারা প্রথমবারের মতো তাদের পৈতৃক শহর, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর নগরী খুলনায় যাচ্ছে।

তিনি বলেন, “আমার বয়স তখন ১৭, যখন আমার পরিবারের সঙ্গে আমি ১৯৪৭ সালের পর দ্বিতীয় অভিবাসনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। ১৯৮৭ সালে আমি একবার আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে খুলনা গিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ট্র্যাজেডি থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন আত্মীয় এখনও সেখানে আছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। গত ১৫ বছরে, যখনই আমরা খুলনায় যেতে চেয়েছি তখনই আত্মীয়স্বজনরা নিষেধ করেছেন। তারা শুধু বলতেন, “এখান অবস্থা ভালো না।” এর একমাত্র কারণ ছিল শেখ হাসিনার পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব ও নীতি।”

পরিবেশ বদলে গেছে

জনাব আখতার ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর তার ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে তার আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে যাচ্ছেন। শুধু পাকিস্তানেই নয় বাংলাদেশেও একই অনুভূতি বিরাজ করছে।

ঢাকার তরুণ সাংবাদিক মারুফ হাসান হাসিনা-শাসনের পতন ঘটানো সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সহিংসতা ব্যাপকভাবে কভার করেছেন। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভুতি বেড়েছে।”

“অনেকের মধ্যে এই অনুভূতি সবসময় থাকলেও তারা সেটা প্রকাশ করতে পারতো না। এখন, তারা সাহসিকতার সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ করছে। এর পেছনে রয়েছে, জাতিগত বন্ধন এবং ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী মনোভাবের প্রভাবসহ বেশ কয়েকটি কারণ।”

হাসিনা-শাসন পরবর্তী ঘটনাবলী একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের সম্পর্কের “নতুন অধ্যায়” সূচনার আহ্বান জানান। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংলাপের উপর গুরুত্ব দিয়ে শেহবাজ তাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।

গত মাসে করাচি থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে, যা দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ স্থাপন করে। অনেকে এটাকে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ থেকে চিনি, চাল ও আলু রপ্তানির আদেশ পেয়ে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বেশ উৎফুল্ল। কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম পাকিস্তান নদীমাতৃক দেশটিতে ২৫,০০০ টন চিনি রপ্তানি করবে।

এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল গত সপ্তাহে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের সাথে দেখা করে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার আশ্বাস দিয়েছেন এবং তাদেরকে আগামী জানুয়ারিতে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় (ডিআইটিএফ) অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং ট্রেড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ পাকিস্তানের (টিডিএপি) চেয়ারম্যান জুবায়ের মতিওয়ালা বলেন, “[শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে] বিষয়গুলো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে”। তিনি সম্প্রতি করাচিতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার এস এম মাহবুবুল আলমের সাথে একান্তে বৈঠক করেন।

মতিওয়ালা বলেন, “হাসিনা সরকারের আমলে আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া ছিল অবিশ্বাস্যরকম কঠিন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা সুযোগগুলো কাজে লাগাতে আগ্রহী। ঢাকা বাণিজ্য মেলা এই সুযোগ এনে দিতে পারে।”

সতর্ক আশাবাদ

ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো: ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কি ভারতের সাথে কয়েক দশকের গভীর সম্পর্ক একদিকে রেখে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে? তার চেয়েও বড় কথা, ভারত কি এই পরিবর্তন সহজে মেনে নেবে? যদি মেনে না নেয় তখন বাংলাদেশে তার প্রভাব ও বিনিয়োগ রক্ষায় কতদূর পর্যন্ত যাবে?

লেখক ডক্টর মুনিস আহমারের মতে এ ব্যাপারে অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। মূল প্রশ্ন হল বাংলাদেশ একাত্তরের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না, যা ভারত তার স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগাচ্ছে এবং পাকিস্তান কোনোভাবে সেই ক্ষত সারতে পারবে কিনা।

করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক এই ডিন বলেন, “মুহাম্মদ ইউনূসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবশ্যই পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। কিন্তু এটি বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করছে। আমরা খুব ভালো করেই জানি যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, সিভিল সোসাইটি, বুদ্ধিজীবী মহল, এমনকি সামরিক বাহিনীতেও এর গভীর শিকড় রয়েছে। তাই ইউনূস এগিয়ে আসতে চাইলেও তার হাত কিন্তু বাঁধা।”

তিনি, বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে “ঐতিহাসিক জটিলতার” কথা উল্লেখ করেন। যেমন, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় দিবস পালন করে। পাকিস্তান দিনটিকে ‘ঢাকার পতন’ হিসাবে বিবেচনা করে। “নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার” জন্য ঢাকার দাবি পাকিস্তান সরকার মেনে নিবে কিনা সে বিষয়ে ডঃ আহমারের সন্দেহ আছে।

তিনি বলেন, “২০০২ সালে জেনারেল মোশাররফ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে ঢাকার অদূরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেছিলেন। এটি ছিল ক্ষমা চাওয়ার খুব কাছাকাছি মনোভাব। তিনি ‘আমরা দুঃখিত’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।”

“তবে, আবারো বাংলাদেশীদের উচ্ছ্বাস তুঙ্গে… দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই মোদি সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ। অন্তত এই মুহূর্তে তারা যে বাংলাদেশকে হারিয়েছে, এটা তারা মেনে মেনে নিতে পারছে না,” বলেন ডঃ আহমার।

এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ