বাংলাদেশকে কেন সমীহ করতে হবে

বাংলাদেশকে কেন সমীহ করতে হবে

বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসায়নেস (ইসকন)-কে নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর দেশটির সহনশীলতার উত্তরাধিকার বজায় রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার এবং ২৬ নভেম্বর কিছু ‘ইসকন সমর্থকে‘র হাতে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু মিডিয়া আউটলেটের ভুল উপস্থাপনা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বিতর্ককে উসকে দিয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ এবং ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। এটি তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক (আরএমজি) এবং বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাক এবং ক্ষুদ্রঋণ অর্থায়নের অগ্রদূত, অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের আবাসস্থল। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরুত্থান এবং ৯০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যার দেশটি থিওক্রাসির দিকে ধাবিত হবে কিনা তা নিয়ে কিছু মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ দেশটিকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথেও তুলনা করছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার গল্প তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে নিহিত। পাকিস্তানের বিপরীতে, যেখানে ধর্মীয় মতাদর্শ শাসন কাঠামো গঠনের কেন্দ্রবিন্দু, বাংলাদেশের পরিচয় হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, বাংলাদেশিরা ধর্মীয় অভিন্নতার পরিবর্তে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের ওপর জোর দেয়।

১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে স্বায়ত্তশাসনের আহ্বানে “বাংলাদেশী” শব্দটি অনন্য জাতীয় পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধ বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের দাবির ভিত্তিকে মজবুত করে, যা আজও এর রাজনৈতিক ও সামাজিক ল্যান্ডস্কেপ গঠন করে চলেছে।

সাম্প্রতিক অস্থিরতার কেন্দ্র ইসকন সমর্থকদের একটি সমাবেশ। ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে তাদের ওই সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাথে যুক্ত –একটি গেরুয়া পতাকা ওড়ানো হয়। জাতীয় পতাকার জন্য অমর্যাদাকর এই কাজ তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এর জের ধরে জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের প্রতি অবমাননার অভিযোগে ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়।

আদালত ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করলে ইসকনের সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা প্রিজন ভ্যান ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা গাড়ি ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং আদালত মসজিদ কমপ্লেক্সের জানালাসহ সরকারী সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করলে পরিস্থিতি দ্রুত সহিংস হয়ে ওঠে। সংঘর্ষ চলাকালে, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে বিক্ষোভকারীরা কুপিয়ে হত্যা করে এবং তার লাশের অবমাননা করা হয়, যা জনগণের ক্ষোভ তীব্র করে তোলে।

যদিও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিতে পারে কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রায়ই এই ঘটনাগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। তারা বাংলাদেশের প্রশংসনীয়, সহনশীলতা ও সহিষ্ঞুতা বজায় রাখার দীর্ঘ ঐতিহ্য উপেক্ষা করে। তাদের প্রতিবেদনে স্থানীয় প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের অনন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে উপেক্ষা এবং পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সাথে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ভারসাম্য রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালের রায়ে আরও বলা হয়েছে যে ইসলামের স্বীকৃতি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় অবশ্যই আইনের অধীনে সমান সুরক্ষা এবং অধিকার ভোগ করবে। তাই লালমনিরহাটের মতো এলাকায় একই আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দিরের অবস্থান দেশটির সামাজিক কাঠামো এই ভারসাম্যকে প্রতিফলিত করে।

বাংলাদেশিরা তাদের মধ্যপন্থী, নিষ্ঠাবান বিশ্বাস এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত। সুফি ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত, দেশের ধর্মীয় পটভূমি আধ্যাত্মিকতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলে। ধর্মীয় নিরপেক্ষতার উপর রাষ্ট্রের জোর আফগানিস্তানের মত দেশগুলোর ধর্মতান্ত্রিক পরিবর্তনের পুরোপুরি বিপরীত। এমনকি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ও মুসলিম নেতা ও ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থান রক্ষা করেছে।

বিশ্বের অনেক জায়গায় মৌলবাদের উত্থান সত্ত্বেও তা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে ব্যাপক সমর্থন পায়নি। জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকাত-উল-জিহাদ-আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) এর মতো নেটওয়ার্কগুলোকে ভেঙে দেয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষার উপর জোর দিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুর্গাপূজার আগে বেশ কয়েকটি মন্দির ও উপাসনালয় পরিদর্শন করেন। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা তেমন একটা ঘটেনি। বাংলাদেশের কাঠামোগত অবস্থা এবং জনগণের মনোভাব কখনোই তথাকথিত গণতন্ত্রের আবরণে তালেবান-স্টাইলে ক্ষমতা দখল বা পাকিস্তান-স্টইলের আধা-সামরিক শাসনের পক্ষে নয়।

এছাড়াও, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে দেশটির জোরালো উপস্থিতি সীমান্তের বাইরে স্থিতিশীলতা রক্ষার ব্যাপারে তার অঙ্গীকার তুলে ধরে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের সাথে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশ।

একমাত্র ধর্ম যদি রাষ্ট্রের গতিপথকে রূপ দিতে পারত, তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিচ্ছেদ ঘটত না। পরিবর্তে, মানুষের স্বাধীনচেতা প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক উদযাপনের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এমন একটি স্থান তৈরি করেছে যেখানে ধর্মপ্রাণ হওয়া মুক্তমনা এবং প্রগতিশীল হওয়ার সাথে বিরোধপূর্ণ নয়। উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশীরা জীবন দিয়েছিলেন। তারা রক্ত ​​ও ঘাম ভেজা পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন না করা পর্যন্ত ক্ষ্যান্ত হয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে তা বাস্তব। কিন্তু এই সরকারের শক্তিমত্তাও সমান তাৎপর্যপূর্ণ। সতর্কতাও প্রয়োজন। বাংলাদেশকে নিয়ে আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক কারোরই বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। কারণ, ইতিহাস স্বাক্ষী ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা জানে কীভাবে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে হয়।

 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ