২০২৫ সাল ভারতের জন্য তার ভূ-রাজনৈতিক ডোমেইনে আধিপত্য বিস্তারের পথে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরির পাশাপাশি বেশ কিছু সুযোগও এনে দিতে পারে। যেসব দেশ এই মুহূর্তে ভারতের জন্য সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে সেগুলো হল বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার। ভারত-মার্কিন, চীন-ভারত এবং চীন-মার্কিন সম্পর্কও এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বিস্তারের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
বিদায়ী ২০২৪ সালের ঘটনাবলী থেকে ভারতের জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে তার কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া যায়। পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।
আগস্টে একটি গণবিপ্লবের মুখে বাংলাদেশে ভারতপন্থী শেখ হাসিনার শাসনামলের পতন ছিল ভারতের জন্য একাধারে শোক ও বিস্ময়ের। নয়াদিল্লি ঢাকার পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর জন্য পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরিকে ঢাকা পাঠাতে নয়াদিল্লির পাঁচ মাস লেগে যায়। তবে এই সফর বাংলাদেশে দিল্লির ব্যাপারে তীব্র গণঅসন্তোষ তেমন প্রশমিত করতে পারেনি। বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কথিত নৃশংসতার ঘটনা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে অপপ্রচার চালান তা পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তোলে।
শ্রীলঙ্কায় বামঘেষা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল জনতা বিমুখ পেরামুনা (জেভিপি)’র ক্ষমতা গ্রহণ নয়া দিল্লির জন্য আশংকা তৈরি করে। তবে, ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট জেভিপিকে তার ঐতিহ্যবাহী মিত্র চীন থেকে দূরে সরিয়ে নিতে অনুদান প্রকল্পের প্রস্তাব হাতে দ্রুত এগিয়ে যায়। এতে আপাতত ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক কিছুটা হলেও টিকে থাকার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা দিসানায়েকে সাম্প্রতি ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। বিতর্কিত প্রকল্পগুলি হয় বাদ দেওয়া হয়, না হয় আরও আলোচনার জন্য রেখে দেওয়া হয়।
মালদ্বীপের ক্ষমতায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মাদ মুইজ্জুর নেতৃত্বে একটি চীনপন্থী ও ভারত-বিরোধী শাসন। কিন্তু মুইজ্জু অর্থনীতি পরিচালনায় ভুল পদক্ষেপ নিলে তা জনসাধারণের অসন্তোষ তীব্র করতে পারে। ইতিমধ্যে তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের লক্ষণ দৃশ্যমান। সম্পর্ক মেরামত করতে চাইলে নয়াদিল্লিকে মিজু প্রশাসন ও জনসাধারণের অনুভূতির উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখতে হবে।
কমিউনিস্ট দলগুলোর আধিপত্য এবং তাদের চীনের প্রতি ঝোঁকের কারণে নেপাল ভারতের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটি দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী করতে মোদি সরকারের প্রচেষ্টা এবং বেয়াড়া নেপালি রাজনীতিবিদদের দমন করতে নয়াদিল্লির বল প্রয়োগের প্রবণতা অতীতে বহুবার ব্যাকফায়ার করেছে।
বরাবরের মতো, বর্তমান নেপালে কট্টর ভারত-বিরোধী প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি সম্প্রতি চীন সফরে গিয়েছিলেন। এসময় বেইজিংয়ের সঙ্গে কাঠমান্ডুর যেসব চুক্তি হয়েছে তাতে নয়াদিল্লিতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভারতের উত্তরে সীমান্তবর্তী এলাকায় চির অস্থিতিশীল মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহী উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতের উদ্বেগের শেষ নেই।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে নন-বামার খ্রিস্টান উপজাতি এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার চললেও নয়া দিল্লি এর বিরুদ্ধে কথা বলেনি। ভারত বরং জান্তা সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে।
জান্তার উপর চীনের প্রভাব থাকায় ভারত মনে করে উপজাতি বিদ্রোহী ও নির্যাতিত গণতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলোর পরিবর্তে জান্তা সরকারকে সমর্থনে লাভ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে, জান্তা বাহিনী ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী সঙ্গে লড়াইয়ে পর্যদুস্থ হয়েছে, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় খ্রিস্টান উপজাতি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে উদ্বাস্তু স্রোত সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে এই স্রোত ঢলে পরিণত হতে পারে, যা ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এসব রাজ্যের একটি মণিপুর হিন্দু মিতি এবং খ্রিস্টান কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে গত কয়েক মাস ধরে জ্বলছে।
মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ভারতের জন্য অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ট্রাম্প চীনের শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠক ও চুক্তি করবেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো ভারতের জন্য স্বস্তির নয়। কারণ ভারত দীর্ঘদিন ধরে চীন-ভারত সীমান্তে বেইজিংয়ের হুমকির বিরুদ্ধে মার্কিন প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্যের উপর নির্ভর করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার বিষয়ে চুক্তি সই করেছে বলে শোনা যাচ্ছে এবং ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে শি দাওয়াত পেয়েছেন।
ট্রাম্প মোদীকে বন্ধু বলে অভিহিত করলেও তিনি আসলেই ভারতকে বাণিজ্য, শুল্ক, ভিসা ও অভিবাসন প্রশ্নে ছাড় দেবেন কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।
২০২৪ সালে কানাডায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন কানাডিয়ান নাগরিককে হত্যা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা এজেন্টরা যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান নাগরিককে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে বলে অভিযোগ ওঠার পর ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কে নজিরবিহীন টানাপোড়ন তৈরি হয়। এই ঘটনাগুলো দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে চাপের মধ্যে ফেলেছে।
অবস্থা যখন এমন, তখনই মার্কিন আদালতে ভারতীয় টাইকুন ও মোদি ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির বিরুদ্ধে লাভজনক জ্বালানি প্রকল্পে কাজ পেতে কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। ঘুষের অর্থ আসে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের পকেট থেকে। তাই ভারত-মার্কিন কৌশলগত সহযোগিতার খাতিরে ট্রাম্প প্রশাসন মোদি সরকারকে এই অগ্নিগর্ভ অবস্থা থেকে বের করে আনতে কতটা ভূমিকা রাখবে তা দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি টের পেয়ে নয়াদিল্লি দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে। অক্টোবরে রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনের সাইড লাইনে শি’র সঙ্গে বৈঠক করেন মোদি।
ভারতের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি. অনন্ত নাগেশ্বরন মনে করেন রপ্তানি বাড়াতে হলে ভারতের উচিত কিছু খাতে চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো। অতি সম্প্রতি, ভারত ও চীনা সামরিক বাহিনী পূর্ব লাদাখ সীমান্তে টহল নিয়ে সমঝোতায় এসেছে।
জানা গেছে, চীন ও ভারত তাদের বিশেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা শুরু করবে। সীমান্তে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এতদিন তা স্থগিত ছিল। এ লক্ষ্যে, ভারতের বিশেষ প্রতিনিধি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল জানুয়ারিতে বেইজিং যাচ্ছেন। তিনি তার চীনা প্রতিপক্ষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সাথে সীমান্ত বিরোধ ও অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যুতে আলোচনা করবেন। এতে আপাতত হলেও ভারত-চীন সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হতে পারে।
দি সিটিজেন, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ