ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, ৩০ মে ২০২৫, ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরি আইএনএস বিক্রান্ত পরিদর্শনে যান। তার আগেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিন ধরে চলা সংঘর্ষ শেষে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনাথ সিং পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন।
রাজনাথ সিং মাথায় নৌবাহিনীর ক্যাপ পরে ছিলেন। মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তান সৌভাগ্যবান যে ওই সংঘর্ষে ভারতীয় নৌবাহিনীকে নামানো হয়নি।
তাঁর ভাষায়, ‘ভারতীয় নৌবাহিনী নীরব থেকেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রেখেছে। ভাবুন তো, যে বাহিনী চুপ থেকেও একটি দেশের সেনাবাহিনীকে বোতলে বন্ধ করে রাখতে পারে, সে যদি মুখ খোলে তাহলে কী হতে পারে?’
তার দুই দিন পর, ১ জুন পাকিস্তান নৌবাহিনী পাল্টা বার্তা দেয়। তারা এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে জানায়, তারা দুই দিনব্যাপী নৌমহড়া চালাবে। এতে অংশগ্রহণকারীরা ‘পাকিস্তানের সব প্রধান বন্দর ও উপকূলে অপ্রচলিত ও অসম লড়াইয়ের হুমকি মোকাবিলার প্রশিক্ষণ’ নেবে। এই প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন আসে ভারতীয় অপারেশন সিঁদুর ও পাকিস্তানের অপারেশন বুনিয়ান মারসুসের পর।
সংঘর্ষের সূত্রপাত
২২ এপ্রিল, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পাহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন পর্যটক ভারতীয় নাগরিক নিহত হন। ভারত অভিযোগ তোলে, এই হামলায় পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাত আছে। ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
এরপর ৭ মে, ভারত পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে একাধিক স্থানে মিসাইল হামলা চালায়। এতে অন্তত ৫১ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন সেনা ও কয়েকজন শিশু ছিল। এরপর তিন দিন দুই দেশ পরস্পরের বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা চালায়।
এই ৯৬ ঘণ্টার সংঘর্ষে উপমহাদেশের ১৬০ কোটির বেশি মানুষ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। তবে নৌবাহিনী সরাসরি লড়াইয়ে অংশ না নিলেও, তারা পরস্পরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রস্তুত ছিল। স্যাটেলাইট ছবি অনুযায়ী, পাহেলগাম হামলার পরপরই ভারতের আইএনএস বিক্রান্ত পাকিস্তান উপকূলের দিকে এগিয়ে যায় এবং চার দিন আরব সাগরে অবস্থান করে। তারপর এটি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।
পাকিস্তানও তাদের নৌবহর মোতায়েন করে। ২ মে করাচি বন্দরে একটি তুর্কি রণতরি ভেড়ে। পাকিস্তান নৌবাহিনী জানায়, তুর্কি নাবিকেরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে ‘একাধিক পেশাদারি কার্যক্রমে’ অংশ নেয়।
নৌযুদ্ধের প্রাথমিক ইতিহাস
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা কিছুটা কম। তবে বিশ্লেষকদের মতে, রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য এবং পাকিস্তানের এই মহড়া ইঙ্গিত দেয় যে ভবিষ্যতের সংঘর্ষে নৌবাহিনীর বড় ভূমিকা থাকবে। এই ভূমিকায় ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশেরই পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর ভারত উপমহাদেশে থাকা ব্রিটিশ নৌসম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ পায়। প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭) হয়েছিল কাশ্মীর নিয়ে। সেই সময় নৌবাহিনী ব্যবহার করা হয়নি। কাশ্মীরের কিছু অংশ ভারত, কিছু পাকিস্তান ও কিছু চীন নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত পুরো অঞ্চল দাবি করে। আর পাকিস্তান চীনের দখলে থাকা অংশ বাদে বাকি সব নিজের বলে মনে করে।
১৯৬৫ সালের কাশ্মীর যুদ্ধের সময় পাকিস্তান তাদের নৌবহর বৃদ্ধি করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় তারা গাজি নামে একটি সাবমেরিন সংগ্রহ করে। ভারতের তখনো কোনো সাবমেরিন ছিল না। তাদের একটি বিমানবাহী রণতরি ছিল। পাকিস্তানের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো বিমানবাহী রণতরি নেই।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্থলযুদ্ধ শুরু হলে, ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পাকিস্তান নৌবাহিনী করাচি বন্দর থেকে সাতটি রণতরি ও একটি সাবমেরিন নিয়ে গুজরাটের দ্বারকা উপকূলে রওনা হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল দ্বারকার রাডারসহ কিছু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা। পাকিস্তান নৌবাহিনীর তথ্যমতে, তারা ‘প্রতিটি জাহাজ থেকে ৫০টি করে গোলা ছুড়ে’ এই অভিযান চালায়।
অভিযানের জন্য দ্বারকার নির্বাচনের প্রতীকী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে রয়েছে হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র স্থান সোমনাথ মন্দির। এর নামেই পাকিস্তান এই অভিযানের নাম দেয়। দ্বারকার রাডার। রাডার ধ্বংস করা গেলে ভারতের পক্ষে করাচির ওপর বিমান হামলা চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। তখন ভারতকে মুম্বাই বন্দর থেকে রণতরি পাঠাতে হতো। আর সেই রণতরিকে পাকিস্তানের সাবমেরিন গাজি আক্রমণ করতে পারত।
পরিকল্পনাটি পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে পাকিস্তান নৌবাহিনী জানায়, তারা চার মিনিটে ৩৫০টি গোলা ছুড়ে নিরাপদে ফিরে আসে। লাহোরভিত্তিক নৌনিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ শরেহ কাজি বলেন, এটি ছিল কৌশলগত চমক, তবে কোনো ভূখণ্ড বা সমুদ্র এলাকা দখল করা সম্ভব হয়নি। ভারতীয় নৌবাহিনীর তথ্যমতে, পাকিস্তানের ছোড়া গোলার বেশির ভাগই বিস্ফোরিত হয়নি। ফলে কোনো বড় ক্ষতি হয়নি।
১৯৭১: নৌবাহিনীর বড় ভূমিকা
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি যুদ্ধে জড়ায়। নৌবাহিনী বড় ভূমিকা নেয়। সেই সময় ভারত অপারেশন ট্রাইডেন্ট ও অপারেশন পাইথন চালায়। এতে পাকিস্তানের পিএনএস খাইবার, পিএনএস মুহাফিজ জাহাজ ডুবে যায়। করাচি বন্দরে জ্বালানি ট্যাংক ধ্বংস হয়।
ভারতীয় সাবেক কমোডোর উদয় ভাস্কর বলেন, ‘নৌবাহিনীর ভূমিকাই স্থলযুদ্ধে বিজয়ের ভিত্তি তৈরি করে।’ পাকিস্তান সাবমেরিন গাজিকেও হারায়। সাবমেরিনটি ভারতের বিশাখাপট্টনম বন্দরে মাইন বিস্ফোরণে ডুবে যায়।
এই যুদ্ধে পাকিস্তানের একমাত্র বড় সাফল্য ছিল সাবমেরিন হাঙর দিয়ে ভারতীয় জাহাজ আইএনএস খুকরিকে ডুবিয়ে দেওয়া। এতে ১৭০ জন নাবিক মারা যান। ভারতের আঘাতে পাকিস্তানের নৌশক্তি প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভিন্ন কৌশল, ভিন্ন লক্ষ্য
১৯৭১ সালের পর ভারত ও পাকিস্তান দুই ভিন্ন ধরনের নৌকৌশল গ্রহণ করে। ভারত ‘ব্লু ওয়াটার নেভি’ গড়ার চেষ্টা করছে; অর্থাৎ যা সমুদ্রপথে দূরদেশেও শক্তি দেখাতে সক্ষম। তাদের উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
ভারত শুধু জাহাজের সংখ্যায় নয়, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে শক্তি বাড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এখন মরিশাস বা প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত অভিযান চালাতে সক্ষম। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে ভারত নৌ-উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের হাতে আছে ২৯টি বড় যুদ্ধজাহাজ, ২টি বিমানবাহী রণতরি, ১২টি ডেস্ট্রয়ার, ১৫টি ফ্রিগেট ও ১৮টি সাবমেরিন (২টি পারমাণবিক)।
অন্যদিকে পাকিস্তান বেশি গুরুত্ব দিয়েছে স্থল ও বিমানবাহিনীতে। তাদের নৌশক্তি ধীরে ধীরে বেড়েছে চীন ও তুরস্কের সহায়তায়। একই সূত্র অনুযায়ী, পাকিস্তানের নৌবাহিনীর হাতে আছে ১১টি ফ্রিগেট, ৮টি সাবমেরিন, অন্তত ২১টি প্যাট্রোল ভেসেল। পাকিস্তানের কোনো বিমানবাহী রণতরি বা ডেস্ট্রয়ার নেই।
ভারতের লক্ষ্য যেখানে বিশ্বব্যাপী শক্তি প্রদর্শন, পাকিস্তান সেখানে ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করতেই নৌবাহিনী ব্যবহার করে। তাদের ৯৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়। তাই বাণিজ্য নিরাপত্তা তাদের মূল লক্ষ্য। পাকিস্তান উপকূলবর্তী অঞ্চল প্রতিরক্ষায় মনোযোগী। তারা গভীর সমুদ্র অভিযান নয়, উপকূল রক্ষা করে। এ জন্যই তারা সাবমেরিনে বিনিয়োগ করেছে, যেগুলোতে আছে ক্রুজ মিসাইল।
ভবিষ্যতের সংঘর্ষে নৌবাহিনী কতটা জড়াবে?
সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ড্রোনসহ আধুনিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে নৌবাহিনী আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে যদি পাকিস্তান কোনো দুষ্কর্ম করে, তাহলে জবাবের শুরুটা আমাদের নৌবাহিনী করতে পারে।’ বোঝাই যাচ্ছে, যদি আবার সংঘর্ষ হয়, তাহলে নৌবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বেশি।
নৌনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষক বশির আলি আব্বাস বলেন, ‘যদি ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানবিরোধী বড় ভূমিকা নেয়, তাহলে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যুদ্ধজাহাজ একবার আঘাত করলে তা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা বলেই বিবেচিত হবে।’
এই পরিস্থিতিতে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকিও হবে সর্বোচ্চ। তবে এটাও ঠিক যে সিংয়ের বক্তব্যে পরিষ্কার নয় যে তিনি নজরদারি বোঝাতে চেয়েছেন নাকি আগ্রাসন। যদি করাচির মতো শহরে আক্রমণ হয়, তাহলে পাকিস্তানের জবাবও হবে কঠিন।
আল-জাজিরা, ইংরেজি থেকে অনুবাদ