পিন্ডি-ক্রেমলিন সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতি

পিন্ডি-ক্রেমলিন সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতি
পাকিস্তান-রাশিয়া যৌথ সামরিক মহড়া। ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি ওভারচুকের ইসলামাবাদ সফর পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্কের ধারাবাহিক অগ্রগতির ফসল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রাক্কালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মস্কো সফর এই অঞ্চলের ভূরাজনীতে আমূল পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়, যা প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরে-বাইরে ভূ-রাজনৈতিক আলোচনা সাধারণত চীন-ভারত শত্রুতা বা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা দ্বারা প্রভাবিত। তবে, পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্কের উষ্ণতা কেবল এই অঞ্চলের পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটই নয়, একটি ঐতিহাসিক ধারার ধারাবাহিকতাও নির্দেশ করে।

ইতিহাসে উত্থানপতন

স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ায় পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের ছন্দকে অনুসরণ করছে। জোসেফ স্টালিন নতুন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সমালোচক ছিলেন এবং দেশ দুটিকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ বলে মনে করতেন। ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে, দক্ষিণ এশিয়া ছিল শীতল যুদ্ধের অংশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। পূর্ব ইউরোপ, জার্মানি, তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দো-চীন এবং কোরিয়ান উপদ্বীপের মতো থিয়েটারগুলোতে শীতল যুদ্ধ মঞ্চস্থ হচ্ছিল।

১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর জন ফস্টার ডুলসের “নর্দান টায়ার” কৌশল বাস্তবায়ন শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়া প্রতি সোভিয়েতের আগ্রহ বাড়তে থাকে। কমিউনিজমকে প্রতিরোধ করার জন্য তুরস্ক, ইরাক, ইরান এবং পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ঠেকাতে সোভিয়েতদের ভারতের পিছনে দাঁড় করায়। অন্যদিকে, ভারতের সাথে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা দূর করতে পাকিস্তান আমেরিকানদের এই অঞ্চলে টেনে আনতে আগ্রহী ছিল। তাই তেলের মতো কোনো বৈষয়িক স্বার্থ না থাকলেও পরাশক্তিগুলোর রাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সোভিয়েত সম্পৃক্ততার ভিত্তি স্থাপন করে।

পরবর্তী দশকগুলোতে, পাকিস্তান-সোভিয়েত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তেমন গতিশীল ছিল না। কমিউনিজম মতবাদ নিয়ে সমস্যা, ভূখণ্ড নিয়ে আঞ্চলিক বিরোধ এবং পারমাণবিক পরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞার মতো চুক্তি স্বাক্ষরের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত উদ্দেশ্যও বদলে যায়। তখন আমেরিকানদের প্রতিহত করার বদলে চীনা আধিপত্য ঠেকানো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই কৌশলগত পরিবর্তন পাকিস্তান-সোভিয়েত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করার দ্বার উন্মুক্ত করে। ফলে রাশিয়ার সহায়তায় করাচি স্টিল মিল চালু হয়। তাসখন্দ চুক্তির পর পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত মন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পাকিস্তান সফর করেন।

তবে এই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭০-এর দশকে চীন-মার্কিন সম্প্রীতি এবং ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন আবারো রাশিয়া ও পাকিস্তানকে বিপরীত মেরুতে নিয়ে যায়। ১৯৮০ এর দশকে আমেরিকান-চীন সমর্থিত এবং পাকিস্তানের নেতৃত্বে “আফগান জিহাদ” সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আফগান জিহাদের তিক্ততা এবং শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে আন্দ্রে কোজিরেভের বিখ্যাত “তিন বৃত্ত” মতবাদ অনুযায়ী রাশিয়ার পরিবর্তিত অগ্রাধিকার পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ককে একটি স্থবিরতার মধ্যে আটকে দেয়।

পুনরুজ্জীবন এবং পুনরুত্থান

পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয় এক দশক আগে। এ সময় পশ্চিমের সাথে সম্পর্কে কোনো অর্থপূর্ণ অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়া “পিভোট টু দি ইস্ট” নীতি গ্রহণ করে এবং এশিয় দেশগুলোর প্রতি নজর দেয়। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক ঊর্ধ্বমুখী করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বিশেষ করে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের গভীর সম্পৃক্ততা; চীন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি “সীমাহীন” অংশীদারিত্বের উত্থান এবং চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। ২০১৭ সালে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় পাকিস্তানের যোগদান বৃহত্তর পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পৃক্ততার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম হাজির করেছে।

করাচি-লাহোর গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি সই এবং ২০১৬ সালে রুশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রথমবারের মতো সামরিক মহড়া, ইত্যাদি দুই দেশের সম্পর্কের উত্থান নির্দেশ করে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সাথে এই প্রক্রিয়াটিকে আরও দ্রুততর করে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের স্বীকৃতির মতো আঞ্চলিক ইস্যুতে রাশিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান অভিন্ন নীতি দেখা যাচ্ছে। তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দিতে রাশিয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত থেকে এটি বুঝা যায়।

সুক্ষ্ম ভারসাম্য

এত পরিবর্তনের মধ্যে একটি ধারা অবিচল: পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক সর্বদা রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং পাকিস্তানের সমন্বয়ে গঠিত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পঞ্চভূজের উপসেট হিসাবে কাজ করেছে। এটি মাথায় রেখে, সম্পর্কটি জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের মতো ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। অস্ত্র বিক্রির মতো ডোমেইনে উদ্যোগী হওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ককে জটিল করে তুলতে পারে। কারণ এটি ভারতীয় সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করবে।

রাশিয়ার সাথে তার ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পশ্চিমা প্রচারণায় অংশ নিতে অস্বীকার করে ভারত অত্যন্ত সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককে বিশ্ব রাজনীতিতে একমাত্র ধ্রুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন, বেলায় মস্কোর কাছ থেকে একই প্রতিদান আশা করে।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক বেলআউটের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের উপর দীর্ঘস্থায়ী নির্ভরতা রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন শক্তি সঞ্চার করার প্রচেষ্টাকে সীমিত করে। এটি স্পষ্ট হয় যখন পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনা জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়াকে ইউক্রেনে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নিন্দা করে পশ্চিমা লাইনের দিকে আঙুল তুলতে হয়েছিল। আইএমএফ বেলআউটের বিনিময়ে পাকিস্তানের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইউক্রেনে পৌঁছানোর রিপোর্ট রাশিয়ার সাথে একটি স্বাধীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের কৌশলগত সীমাকে দেখিয়ে দেয়।

পাকিস্তানের দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাও একটি বাধা। ইসলামাবাদকে শোধনাগারের প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাবে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল আমদানির পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়।

যাইহোক, সম্পর্ক পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় বাধা পাকিস্তানের এলিট শ্রেণীর পশ্চিমাপন্থী মনোভাব। চীন এবং ইরানের মতো রাশিয়ার অন্যান্য আঞ্চলিক অংশীদারদের বিপরীতে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী এবং উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক মডেলকে আদর্শ মনে করেন। পশ্চিমের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের উচ্চ ব্যক্তিগত অংশীদারিত্ব রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের “গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার” ধারণার কারণেও তারা রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধাগ্রস্ত।

সম্পর্কের ভবিষ্যৎ

দক্ষিণ এশিয়া আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উদীয়মান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দু। তাই, অতীতের দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক অভিনেতারা নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, যার মধ্যে পুরানো সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনাও রয়েছে। পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্কের নতুন গতিশীলতা তারই উদাহরণ। রাশিয়া এবং পাকিস্তান একটি নতুন বোঝাপড়া তৈরি করার জন্য তারা কতটা সময় ব্যায় করবে সেটা দেখর বিষয়।

মার্ক টোয়েনের উক্তি স্মরণ করে বলতে হয়, “ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে না, তবে এটি প্রায়শই বলতে শোনা যায়।” পাকিস্তান-রাশিয়া সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ইতিহাসকে অতিক্রম করে যেতে হবে। তবে এটা ঠিক ভবিষ্যতের রোডম্যাপ অতীত ইতিহাসের ভিত্তিতেই এগিয়ে যায়।

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ