পাক-ভারত উত্তেজনা: অগ্নিপরীক্ষায় শ্রীলংকার পররাষ্ট্র নীতি

পাক-ভারত উত্তেজনা: অগ্নিপরীক্ষায় শ্রীলংকার পররাষ্ট্র নীতি
(বায়ে) গত ডিসেম্বরে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েক। (ডানে) এ বছর জানুয়ারীতে বেইজিংয়ের গ্রেট হলে দিসানায়েককে স্বাগত জানাচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা কারণে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছে শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের জোটনিরপেক্ষ নীতি। দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশটির এখন “শ্যাম রাখি না কুল রাখি” অবস্থা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি নিরাপত্তা ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি কলম্বোর ঝোঁক, বিশেষ করে গত এপ্রিলে প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের কারণে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। কারণ তারা চীনা বিনিয়োগের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কলম্বো সফরের সময়, ৫ মে ভারত ও শ্রীলঙ্কা যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি সই করে তা ছিল ১৯৮০ সালের পর প্রথম কোন আনুষ্ঠানিক চুক্তি। এতে যৌথ সামরিক মহড়া ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও চুক্তির পূর্ণ বিবরণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

চুক্তিটি সইয়ের মাত্র এক মাসের মাথায়, ৭ মে, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিরপেক্ষা তদন্তের আগেই পাকিস্তানের উপর দায় চাপিয়ে ভারত প্রতিশোধ নিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে।

ভারত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে “সন্ত্রাসী অবকাঠামো” লক্ষ্য করে হামলা চালায়। পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান। যদিও মাত্র চার দিনের মাথায় দুই তরফ থেকেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়।

এই সংঘর্ষ শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশগুলোকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। এর সুদূরপ্রসারি ফলাফল নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত। দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে তারা কোন কূলকিনারা পাচ্ছে না।

ওয়াশিংটনের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের সহকারী ফেলো নীলান্তি সমরানায়েকের মতে, কলম্বো দীর্ঘদিন ধরে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে। এর জন্য ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে পারদর্শী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কিন্তু, সাম্প্রতিককালে চীনের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের গভীরতা এবং ভারত-চীন সম্পর্কে অবনতি – এমন একটি আঞ্চলিক পরিবেশ শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্য সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলা বেশ করে তুলেছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কারণে চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ক্রমেই সুদৃঢ় হয়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) এবং পাকিস্তানকে জে-১০সি যুদ্ধবিমান সরবরাহের মতো সামরিক সহযোগিতা – ইসলামাবাদকে বেইজিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারে পরিণত করেছে।

শ্রীলঙ্কার ওপেন ইউনিভার্সিটির আইনজীবী ও সাবেক প্রফেসর অনুথথারা একেলি বলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক সহযোগিতার কারণে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন “লৌহদৃঢ়” মজবুত।

অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন আরো বাড়বে বলে একেলি মনে করেন।

তিনি সতর্ক করে বলেন, শ্রীলঙ্কা যদিও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে চাইবে কিন্তু তারা দিল্লির সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখালেও বেইজিং একে কৌশলগত প্রতিপক্ষের প্রতি পক্ষপাত বলে ব্যাখ্যা করতে পারে।

দিল্লির সাথে কলম্বোর সাম্প্রতিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রচেষ্টাকে আরো জটিল করে তুলছে। কারণ, বেইজিং এবং ইসলামাবাদ একে “ভারতের নিরাপত্তা বলয়ে শ্রীলঙ্কার প্রবেশ” বলে মনে করতে পারে।

সামারনায়কে বলেন, শ্রীলঙ্কা পাক-ভারত সংঘাত থেকে দূরে থাকতে চাইলেও এমন এক উত্তেজনার মধ্যে তারা প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করে, যখন একে “পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের গুরুত্ব এবং ভারতকে প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে শ্রীলঙ্কার স্বীকৃতি” প্রদান হিসেবে দেখা হতে পারে।

একেলি মনে করেন, অপারেশন সিঁদুর তাৎক্ষণিক কৌশলগত উদ্দেশ্যের বাইরেও ভারতের একটি দীর্ঘমেয়াদী নীতির ইঙ্গিত দেয়, যা দক্ষিণ এশীয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে।

শ্রীলঙ্কার জন্য এর দুটি প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন একেলি। প্রথমত, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং দ্বিতীয়ত, সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় ভারতের ক্রমবর্ধমান যুদ্ধংদেহী ভঙ্গী।

উভয়সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ২০২২ সালের সংকট কাটিয়ে ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে কিন্তু এই আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ চীন এবং ৯ শতাংশ ভারতের কাছ থেকে নেয়া। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে কলম্বোর ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ পুনর্গঠন চুক্তির ক্ষেত্রে দুই দেশই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একেলি মনে করেন, ইসলামাবাদের সাথে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার মতো অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভারত এমন একটি প্রবণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে যেখানে ভূ-রাজনীতি সরাসরি অর্থনৈতিক উপকরণগুলোকে প্রভাবিত করবে।

এটা যুদ্ধোত্তর ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে ভারতীয় বাজার এবং চীনা মূলধনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কার পক্ষে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টাকে কঠিন করে তুলতে পারে।

একেলি বলেন, শ্রীলঙ্কা চীনের বিআরআই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের কলম্বো পোর্ট সিটি ভূমি পুনরুদ্ধার এবং দক্ষিণে হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দরের মতো হাই-প্রোফাইল প্রকল্প পরিচালনায় চীন যুক্ত। তাই, কলম্বো ভারতের দিকে ঝুঁকছে এমন যেকোনো ধারণা চীনকে উপস্থিতি আরও জোরদার করতে উৎসাহিত করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, অপারেশন সিঁদুর সম্ভবত কলম্বোর কূটনৈতিক আচরণের প্রতি বেইজিংয়ের নজরদারি বাড়াবে এবং কলম্বোর কাছ থেকে তারা আরো আনুগত্য আশা করবে।

চলতি (মে) মাসের শুরুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে, শ্রীলঙ্কা মন্ত্রিসভার মুখপাত্র ডঃ নালিন্দা জয়তিসা জোটনিরপেক্ষ নীতির উপর জোর দেন।

তিনি বলেন, আমাদের ভূমি, জল এবং আকাশসীমা কোন দেশকে আরেক দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আমরা এই অবস্থানে অটল আছি ।

তার বক্তব্য পাহেলগাম হামলার পরপরই প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমার দিশানায়েকের প্রতিক্রিয়ার বিপরীত। তখন তিনি সন্ত্রাসী হামলার “তীব্র নিন্দা” করেন এবং মোদীর সাথে টেলিফোনে ভারতের জনগণের প্রতি “সংহতি” প্রকাশ করেন।

শ্রীলঙ্কা-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ফ্যাক্টামের প্রধান বিশ্লেষক উদিতা দেবপ্রিয়া বলেন, দিশানায়েকের মন্তব্য পাকিস্তানিদের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ, তারা মনে করতে পারে, শ্রীলঙ্কা পরোক্ষভাবে বলতে চাচ্ছে যে ইসলামাবাদ জঙ্গিদের সমর্থন করছে।

শ্রীলঙ্কা পুরো পরিস্থিতিতে সুন্দরভাবে সামাল দিতে পারেনি বলে দেবপ্রিয়া মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে যে অবস্থানে ছিলাম এখন সেই অবস্থানে নেই।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কা জোটনিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার পরেও কলম্বোতে পাকিস্তানকে জ্বালানি গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়। তবে, সেই সময়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সাথে প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের দৃঢ় সম্পর্ক ছিল, যা তাকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল।

অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাকে তার কার্ডগুলো সাবধানে খেলতে হবে। বিভিন্ন পরাশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বে ছোট দেশগুলো কোনও পক্ষে থাকার সামর্থ্য রাখে না বলে দেবপ্রিয় মনে করেন।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আছে চীন, আর ভারতের পিছনে যুক্তরাষ্ট্র। তাই, ভারতীয় উপমহাদেশে ভূ-রাজনৈতিক জটিল বিনুনির মধ্যে উত্তেজনার প্রভাব কলম্বোও অনুভব করছে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ