পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা: রণপ্রস্তুতি নিয়ে ভারতের ফাঁকা বুলি

পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা: রণপ্রস্তুতি নিয়ে ভারতের ফাঁকা বুলি
প্রতীকী ছবি

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চিরাচরিত উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখনই ভারতীয় কর্মকর্তারা একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন: দেশের বিশাল সামরিক বাহিনী আসলে ফাঁপা, সেকেলে শক্তি – সীমান্তে আসন্ন হুমকি মোকাবেলায় একেবারেই অপ্রস্তুত।

২০১৯ সালে পাকিস্তান একটি ভারতীয় বিমান অপমানজনকভাবে ভূপাতিত করার পর ভারত তার বাহিনীকে আধুনিকায়নের প্রবল তাগিদ অনুভব করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সামরিক বাহিনীর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেছেন, অস্ত্র কেনার জন্য নতুন আন্তর্জাতিক অংশীদার খুঁজছেন এবং দেশে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণের উপর জোর দিয়েছেন।

এই প্রচেষ্টা কতটা পরিবর্তন এনেছে এখন তা পরীক্ষা করার সময় এসেছে।

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে বলে নয়া দিল্লি পণ করার পর ভারত এবং পাকিস্তান আরেকটি সামরিক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত আছে বলে ভারতের দাবি। উত্তেজনা এতটাই তুঙ্গে যে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদী সিন্ধু নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এটা এমন এক পদক্ষেপ যা তারা আগে কখনও নেয়নি, এমনকি বিগত কয়েক দশকে দুই দেশের মধ্যে কয়েকবার যুদ্ধ চলার মধ্যেও।

পাকিস্তান কাশ্মীর হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে “যুদ্ধের ঘোষণা” বলে অভিহিত করেছে।

মঙ্গলবার মনোরম পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে দুই ডজনেরও বেশি পর্যটকের হত্যাকাণ্ড ভারতীয়দের হতবাক করে দেয় এবং পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য মোদী প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়েন। বিশ্লেষকরা একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং বিপজ্জনক অচলাবস্থার সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। কারণ, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো কয়েক বছর আগেই শুকিয়ে গেছে এবং বিশ্ব শক্তিগুলো এখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় বাহিনী এখনো সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকায় পাকিস্তানে হামলার চালানোর ব্যাপারে সংযত আচরণ করতে বাধ্য হবে।

২০১৮ সালে এক সংসদীয় প্রতিবেদনে ভারতের ৬৮ শতাংশ সামরিক সরঞ্জামকে “প্রাচীন”, ২৪ শতাংশ সমসাময়িক এবং মাত্র ৮ শতাংশকে অত্যাধুনিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। পাঁচ বছর পরে এসেও সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন তাদের চ্যালেঞ্জগুলো এত বিশাল যে অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।

২০২৩ সালে সংসদে বলা হয়, অত্যাধুনিক সরঞ্জাম প্রায় দ্বিগুণ হলেও, এগুলো এখনও একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এখনো অর্ধেকেরও বেশি পুরনো সরঞ্জাম নিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে চলতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সীমাবদ্ধতার কারণে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ধরনের অপারেশন বেছে নিতে বাধ্য হবেন মোদী – যেমন সীমিত বিমান হামলা বা পাকিস্তান সীমান্তের কাছে বিশেষ বাহিনীর অভিযান চালানো। এতে জনসাধারণের ক্ষোভ প্রশমিত হবে, বিব্রতকর পরাজয়ের ঝুঁকি কম এবং পাল্টা প্রতিশোধ এড়ানো যাবে। যেকোনো ভারতীয় হামলা প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে পাকিস্তান সরকার।

জনসাধারণের আবেগের কারণে মোদী পাকিস্তানে হামলা চালাতে পারেন, তবে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়।

অন্যদিকে, পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক বাহিনী পর্দার আড়াল থেকে দেশটিকে পরিচালিত করে আসছে। তাই সেখানকার নেতারা খুশি মনে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধা হাসিলের পথ খুঁজতে পারেন।

ভারত এমন ভাব দেখাতে চায় যেন তারা সহজেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে হারিয়ে দিতে পারে। যদি সেই দাবি যাচাইয়ের চেষ্টা করে, তাহলে আরেক প্রতিবেশী চীন কড়া নজরে ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে।

সাম্প্রতিককালে, ভারত চীনকে পাকিস্তানের চেয়েও গুরুতর সীমান্ত চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচনা করছে, বিশেষ করে ২০২০ সালে দোকলাম ঘটনার পর থেকে। ভারতীয় ভূখণ্ডে অহরহ চীনা অনুপ্রবেশ ঘটে। তাই ভারতীয় সামরিক নেতাদের দুই ফ্রন্টের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, যা সীমিত সম্পদের কারণে প্রায় অসম্ভব।

পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় বিমান ভূপাতিত এবং এর পাইলটকে আটক করার প্রায় এক বছর পর ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় জেনারেল দুষ্মন্ত সিংয়ের মতে, বিমান ভূপাতিত করা ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য একটি সতর্কবার্তা।

তিনি বলেন, তারপর থেকে সামরিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে ভারত “বহু পথ” অনুসন্ধান করেছে। আমেরিকার আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে, ফ্রান্স থেকে কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করেছে।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহ লাইন ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ভারত স্থানীয়ভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের পেছনে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে, প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপন করেছে যা বর্তমানে ধীর হলেও, দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনীকে আরও ভাল অবস্থানে রাখবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জগুলো বহুমুখী: আমলাতান্ত্রিক এবং আর্থিক, আবার ভূ-রাজনৈতিকও।

প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়াকে সহজতর করার চেষ্টা করছেন মোদী। পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় উন্নত করার চেষ্টা করছেন, যা কঠিন প্রমাণিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করার জন্য মোদী একজন জেনারেলকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন যিনি ২০২১ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান। এতেও ভারতের বেশ ক্ষতি হয়েছে।

ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম, পাকিস্তানের প্রায় ১০ গুণ বড়। কিন্তু প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের ব্যয় এখনও তার মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশেরও কম, যা সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে অপর্যাপ্ত। দেশের বিশাল জনসংখ্যার অপরিমেয় চাহিদা মেটাতেই সরকারকে হিমশিম খেতে হয়।

২০২০ সালে চীনের সাথে সংঘর্ষের পর ভারত চার বছর ধরে সীমান্তে কয়েক হাজার সৈন্য মোতায়েন রাখে, যা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। এতে আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা অনেক পিছিয়ে যায়। এখন বড় বাধা হল ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে ভারতের বৃহত্তম উৎস – রাশিয়া থেকে অস্ত্র পেতে সমস্যা হচ্ছে।

সংসদে দেয়া বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, টাকা থাকার পরও সামরিক বাহিনী খরচ করতে পারছে না। কারণ “বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি”-এর কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটছে, অর্ডার দিয়েও সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে না।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে যে পাঁচটি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা হয় তার মধ্যে তিনটি মোতায়েন করা হয়েছে। ফ্রান্স থেকে কেনা ৩৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমানের সবকটিই বাহিনীর অংশ হয়ে গেছে এবং ভারত আরও ২৬টি অর্ডার করার পরিকল্পনা করছে। ভারত দেশে তৈরি বিপুল সংখ্যক যুদ্ধজাহাজ কমিশন করছে।

নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় ​​শুক্লা বলেন, সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল রাফালের অন্তর্ভুক্তি, যা ভারতীয় বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।”

তবে তিনি বলেন, উদ্বেগের বিষয় হল “আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র আছে বলে আমরা দাবি করি। কিন্তু দিন শেষে যখন সেগুলো ব্যবহারের সময় আসে, তখন দেখা যায় যে আমাদের কাছে আসলে সেগুলো নেই।”

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন মাসুম বিল্লাহ