ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার মধ্যে ওয়াশিংটন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে অপ্রত্যাশিত উষ্ণতা এই তিন দেশের সম্পর্কের গতিশীলতা নতুন করে লিখছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। তার উপর রয়েছে অনির্ধারিত পরিমাণ “জরিমানা”। এর কারণ হিসেবে তিনি নয়াদিল্লির চাতুরিপূর্ণ বাণিজ্য বাধা এবং রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনার কথা উল্লেখ করেছেন।
এই ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মাথায় ট্রাম্প পাকিস্তানের সাথে একটি “বিশাল” তেল অনুসন্ধান চুক্তির কথা ঘোষণা করেন। তখন ভারতকে একরকম “খোঁচা” দিয়ে তিনি বলেন যে একদিন ভারতও ইসলামাবাদ থেকে তেল কিনতে পারে।
এসব ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, এতদিন চলে আসা মার্কিন-পাকিস্তান-ভারত ত্রিভুজটি বদলে গেছে।
তার মতে, পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে “অপ্রত্যাশিত পুনরুত্থান” ঘটেছে। তিনি বলেন, গত দুই দশক ধরে ওয়াশিংটন এবং ভারত যখন একটি গভীর কৌশলগত অংশীদারিত্বের পথে হেটেছে, তখন এই আকস্মিক পরিবর্তন নয়াদিল্লির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে।
কুগেলম্যান বলেন, সঙ্কটের মুহূর্ত এসেছে, পথে বাধা এসেছে কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাটিয়ে ওঠা গেছে। কিন্তু এবার আপনি দেখবেন যুক্তরাষ্ট্র বারবার বার্তা দিচ্ছে তা ভারতকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্প এখন পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য ২৯ বার কৃতিত্ব দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ধারাবাহিকভাবে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান কাশ্মীর বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন।
পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ট্রাম্পের ভূমিকার প্রশংসা করেছে এবং কাশ্মীর ইস্যুতে তার প্রস্তাব লুফে নিয়েছে। অন্যদিকে, ভারত তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ মানতে নারাজ এবং জোর দিয়ে বলেছে যে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আমেরিকার কোনও ভূমিকা নেই।
জুনের মাঝামাঝি ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল অসীম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানান। এর মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পরে পাকিস্তানের সামরিক নেতা “ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ রোধ করার” জন্য ট্রাম্পকে ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করার প্রস্তাব দেন।
এরপরও ভারত-মার্কিন সম্পর্কে অনেক অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে বলে কুগেলম্যান মনে করেন।
তিনি বলেন, প্রযুক্তি, জ্বালানি এবং উচ্চশিক্ষায় দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত আছে। ভারতের সঙ্গে জোরালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকান ও ভারতীয় বেসরকারি শিল্প নেতাদের মধ্যে আশাবাদ এবং উৎসাহের কমতি নেই। তাই সম্পর্কের এই পরিবর্তনের প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের হতাশ হওয়া উচিত নয়। আমরা যথাসময়ে এর উল্টোগতি দেখতে পাব।
অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ বলেন, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণ হল ইসলামাবাদ ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক নীতি ভালভাবে বুঝতে পেরেছে এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছে।
ড্যানিলোভিচ বলেন, তাৎক্ষণিক উদ্বেগের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন এবং পাকিস্তান দ্রুত এই বিষয়ে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজি করাতে চায় ভারত।
তিনি আরও বলেন, এখনও পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না – তা ভারত হোক বা ইউরোপ ও এশিয়ায় তার দীর্ঘদিনের মিত্র হোক- কারো ব্যাপারেই না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, নয়াদিল্লি লাঠির ছোট অংশ ধরে রেখেছে।
ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে ভারত এবং রাশিয়াকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন যে, এই দুই দেশ তাদের “মৃত অর্থনীতিকে একসাথে” ধ্বংস করতে পারে।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়ত বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনও তুলনা হয় না, আমেরিকা তা জানে।
তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের মতো ভারতও তার কৌশলগত স্বার্থ অনুসরণ করে এবং স্বাধীনভাবে অংশীদারিত্ব রক্ষা করতে চায়। এই নীতিতে কোনও পরিবর্তন হবে না।
তার মতে, আমেরিকা-ভারতের উত্তেজনা কমে আসা উচিত কারণ এই অঞ্চলে আমেরিকার বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলতে কিছু নেই, বরং স্বার্থ হলো স্থায়ী। শেষ পর্যন্ত এগুলো সবই লেনদেনের উপর নির্ভরশীল। তবে মাঝে মাঝে এমন একটি কৌশলগত পরিকল্পনায় অন্যকোন দেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা মাইকেল রুবিন বলেন, পাকিস্তানের দিকে ট্রাম্পের ঝুঁকে পড়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট “কোন স্পষ্ট ছন্দ বা যুক্তি ছাড়াই” পদক্ষেপ নিতে পছন্দ করেন।
ওয়াশিংটন এবং নয়াদিল্লির মধ্যে বিরোধের আরেকটি কারণ হতে পারে ভারত ব্রিক্সের অংশ। এই জোট মার্কিন ডলারের প্রভাব কমাতে কাজ করছে বলে যা ট্রাম্প বিশ্বাস করেন।
সাউথ চায়না মনিং পোস্ট থেকে অনুবাদ