পাকিস্তানের পারমাণু অস্ত্র তৈরি ঠেকাতে ইসরায়েল-ভারত ব্যর্থ হয়েছিল যেভাবে

পাকিস্তানের পারমাণু অস্ত্র তৈরি ঠেকাতে ইসরায়েল-ভারত ব্যর্থ হয়েছিল যেভাবে
২০১০ সালের ৯ জানুয়ারী রাওয়ালপিন্ডি হাইকোর্টে এক অনুষ্ঠানে মুনাজাত করছেন পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক প্রধান জর্জ টেনেট তাঁকে ‘ওসামা বিন লাদেনের মতোই বিপজ্জনক’ বলে মনে করতেন এবং মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শ্যাভিট তাঁকে হত্যা না করার জন্য আফসোস করেছিলেন। তিনি হচ্ছে আব্দুল কাদির খান, পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক। পাকিস্তানের প্রায় ২৫০ মিলিয়ন পাকিস্তানি নাগরিকদের কাছে একজন কিংবদন্তি, একজন জাতীয় বীর। এই পরমাণুবিজ্ঞানী ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৫ বছর বয়সে ২০২১ সালে মারা যান।

আব্দুল কাদির খান ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তার জন্য একটি গোপন অত্যাধুনিক নেটওয়ার্কও পরিচালনা করেছিলেন। এ দেশগুলোর মধ্যে উত্তর কোরিয়াই শুধু পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তি হওয়া থেকে বিরত রাখতে নানা গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছিল এবং হুমকি দিয়েছিল। ইসরায়েল নিজেও পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশ, যদিও তারা তা কখনো স্বীকার করে না।

১৯৮০-এর দশকে ইসরায়েল ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। যদিও ভারত সরকার সেই পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করে দেয়।

আব্দুল কাদির খান বিশ্বাস করতেন যে একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তিনি তাঁর দেশকে বিদেশি হুমকি থেকে বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারত থেকে রক্ষা করেছেন। আজ পাকিস্তানি নাগরিকেরা তেমনটিই মনে করে।

কেন একটি ইসলামিক বোমা নয়?’

প্রতিবেশী দেশ ভারত যখন প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে পাকিস্তানও তখন এমন বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত তার প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা করে, যার সাংকেতিক নাম ছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। এরপর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো অবিলম্বে তাঁর নিজের দেশের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির শপথ নেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ঘাস বা লতাপাতা খাব, এমনকি ক্ষুধার্ত থাকব, কিন্তু আমরা নিজেদের জন্য একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করব।’

তিনি ঘোষণা করেন, ‘একটি খ্রিষ্টান বোমা আছে, একটি ইহুদি বোমা আছে এবং এখন একটি হিন্দু বোমাও আছে। কেন একটি ইসলামিক বোমা থাকবে না?’

ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করা আব্দুল কাদির ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান নিয়ে ডিগ্রি নেন। এরপর বার্লিনে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ধাতু প্রকৌশল বিদ্যা) নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামেও পড়াশোনা করেন।

১৯৭৪ সালে আব্দুল কাদির আমস্টারডামের অন্যতম পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা ইউরেনকোর একজন সাবকন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছিলেন। কোম্পানিটি ইউরোপের পারমাণবিক চুল্লির জন্য পারমাণবিক জ্বালানি হিসেবে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরবরাহ করত।

আব্দুল কাদির ইউরেনকোর গোপন এলাকায় প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলেন, যেখান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সেরা সেন্ট্রিফিউজের ব্লুপ্রিন্ট। সেখানে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামকে পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য সমৃদ্ধ করা হতো এবং তা পারমাণবিক বোমার জ্বালানিতে রূপান্তরিত করা হতো।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে হঠাৎ করে পাকিস্তানে চলে যান। বিষয়টি ছিল অনেকটা রহস্যময়। যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, ‘পাকিস্তানে এমন একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যা আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি না।’

পরে আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডস থেকে ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের একটি ব্লুপ্রিন্ট চুরি করার অভিযোগ ওঠে, যা ইউরেনিয়ামকে অস্ত্র-গ্রেডের জ্বালানিতে পরিণত করতে পারে।

সেই বছরই জুলাই মাসে তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গবেষণাগার স্থাপন করেন, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করা শুরু হয়।

কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রম চলে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। ডামি কোম্পানি বানিয়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান আমদারি করা হতো। সরকারি ভাষ্য ছিল, নতুন একটি টেক্সটাইল কারখানা তৈরির জন্য এসব উপাদান আমদানি করা হচ্ছে। যদিও উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠান আব্দুল কাদিরের এই কাজকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছিল। তবে এই উদ্যোগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যিনি, প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, একমাত্র তিনি ছাড়া সরকারের সবাই ছিল এ ব্যাপারে অন্ধকারে।

এমনকি ভুট্টোর কন্যা, যিনিও পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, প্রয়াত বেনজির ভুট্টোকেও তার জেনারেলরা ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক প্রযুক্তি আদান-প্রদানের একটি কর্মসূচির বিষয়ে কোনো কিছুই জানাননি। ১৯৮৯ সালে তেহরানে গিয়ে ঘটনাক্রমে এ বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।

ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে তাঁরা ‘বিশেষ প্রতিরক্ষা বিষয়’ নিয়ে দুই দেশের চুক্তিটি পুনর্বহাল করতে পারেন কিনা। বেনজির ভুট্টো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি ঠিক কী বিষয়ে কথা বলছেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব?’

ইরানি প্রেসিডেন্ট তখন উত্তর দিলেন, ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি, ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, পারমাণবিক প্রযুক্তি’। বেনজির ভুট্টো তখন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

গুপ্তহত্যার চেষ্টা এবং হুমকি

১৯৭৯ সালের জুনে ‘এইট ডেজ’ ম্যাগাজিনে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায়। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচন্ড উত্তেজনা তৈরি হয়। ইসরায়েল তখন ডাচ সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, যেহেতু আমস্টারডামে ইউরেনকোতে চাকরি করতেন আব্দুল কাদির। ডাচ সরকার তখন এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দেয়।

নেদারল্যান্ডসের একটি আদালত ১৯৮৩ সালে আব্দুল কাদিরকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রচেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। যদিও পরবর্তীতে কারিগরি নিয়মের কারণে রায়টি বাতিল হয়ে যায়। অন্যদিকে তখন পাকিস্তানে পারমাণবিক কর্মসূচির কাজ চলতে থাকে। ১৯৮৬ সালের মধ্যে আব্দুল কাদির নিশ্চিত হয়ে গেলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে।

কয়েকজনকে গুপ্তহত্যাসহ পাকিস্তানের এ পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য জোরালোভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় এর পেছনে যুক্ত ছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।

পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে নিতে আব্দুল কাদিরের সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত থাকা ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তাদের টার্গেট করা হয়। পশ্চিম জার্মানিতে একজনের কাছে একটি লেটার বোমা (খামবন্দী বিস্ফোরক) পাঠানো হয়েছিল, তিনি রক্ষা পেলেও তার কুকুরটি মারা যায়।

আরেকটি বোমা হামলা চালানো হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি কোরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর লক্ষ্য করে, যে কোম্পানিটি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে কাজ করছিল।

একটি কোম্পানির মালিক সিগফ্রিড শের্টলার সুইস ফেডারেল পুলিশকে বলেছিলেন যে মোসাদ এজেন্টরা তাঁকে এবং তাঁর বিক্রয়কর্মীদের বারবার ফোন করেছিলেন। তিনি বলেন, জার্মানিতে ইসরায়েলি দূতাবাসে কর্মরত ডেভিড নামে এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে তাঁকে পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে ‘এই ব্যবসা’ বন্ধ করতে বলেছিলেন।

ইতিহাসবিদ আদ্রিয়ান লেভি, ক্যাথরিন স্কট-ক্লার্ক এবং আদ্রিয়ান হ্যানি যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে মোসাদ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে পাকিস্তানকে আটকাতে ব্যর্থ হয়ে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল।

পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সাবেক কর্মকর্তা ফিরোজ খানের মতে, ‘একটি মুসলিম দেশের কাছে পারমাণবিক বোমা থাকবে এটি চাইত না ইসরায়েলিরা।’

ইসরায়েল ভারতের অভিযানের পরিকল্পনা

১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে ইসরায়েল ভারতকে প্রস্তাব দেয় যে উভয় দেশ মিলে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির সেই পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করার।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

ইসরায়েলি এফ-১৬ এবং এফ-১৫ বিমান নিয়ে এ হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভারতের গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেই পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হবে।

কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী পরে পিছিয়ে আসেন এবং পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়।

১৯৮৭ সালে ইন্দিরার ছেলে রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও আরেকবার পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করা হয়। ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কৃষ্ণস্বামী সুন্দরাজি পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করেছিলেন, যাতে ভারত পাকিস্তানের সেই পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলতে পারে। তিনি সামরিক মহড়ার জন্য পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা ও কয়েক শ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পাকিস্তান সীমান্তে পাঠিয়েছিলেন। এটি ছিল পাকিস্তানের জন্য বড় একটা উসকানি।

কিন্তু শত্রুতা উসকে দেওয়ার এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেনাপ্রধানের সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত ছিলেন না। তিনি তখন পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর পদক্ষেপই নিয়েছিলেন।

স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্র চীনের সহায়তা 

ভারত এবং ইসরায়েলের নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই গোপনে পাকিস্তানকে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে নিতে সহায়তা করেছিল। চীন পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ট্রিটিয়াম এবং এমনকি বিজ্ঞানীও সরবরাহ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এ কাজে সহায়তা করেছিল কারণ সেসময় পাকিস্তান ছিল সোভিয়েতের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর এর প্রতিক্রিয়ার ফলে ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পাকিস্তানকে সহায়তা বন্ধ করে দেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আক্রমণ করার কয়েক মাস পরে সিদ্ধান্তটি বাতিল করেন।

১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে পাকিস্তানের পরমাণুবিজ্ঞানীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেয় এবং পাকিস্তানের এ কর্মসূচির বিষয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে যায়। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতিবাদে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান তখন জানায় যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন বন্ধ করে দেবে।

তবে আব্দুল কাদির পরে প্রকাশ করেন যে তখনও উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন গোপনে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা।

সপ্তম পারমাণবিক শক্তি

১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত তার পারমাণবিক ওয়ারহেড পরীক্ষা করে। এরপর পাকিস্তান সেই মাসের শেষের দিকে বেলুচিস্তানের মরুভূমিতে সফলভাবে তাদের নিজেদের পরীক্ষা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এর প্রতিক্রিয়া জানায়।

পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠে। আব্দুল কাদির খান পরিণত হন একজন জাতীয় বীরে। কোথাও গেলে প্রধানমন্ত্রীর মতোই বড় শোভাযাত্রাসহ নিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো। তাঁর প্রহরায় থাকতো সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। তাঁর নামে রাস্তা, স্কুল এবং একাধিক ক্রিকেট দলের নামকরণ করা হয়। নিজের অর্জনের বিষয়েও কোনো লুকোছাপা করতেন না তিনি। জাতীয় টিভি চ্যানেলে ঘোষণা দিয়েছিলেন এইভাবে, ‘কে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে? আমিই সেটি তৈরি করেছি’, ‘কে মিসাইল তৈরি করেছে? আমি আপনাদের জন্য সেগুলো তৈরি করেছি।’

তবে আব্দুল কাদির আরও একটি বিশেষ দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি একটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করতেন, যার মাধ্যমে ইরান, উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়াতে প্রযুক্তি ও নকশা পাঠানো হতো।

তিনি পাকিস্তানি পারমাণবিক কর্মসূচির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্ডার করতেন এবং তারপর গোপনে অতিরিক্তগুলো বিক্রি করে দিতেন।

১৯৮০-এর দশকে ইরানের সরকার পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগও করে। যদিও আয়াতুল্লাহ খোমেনি এ বোমা তৈরির বিরোধিতা করতেন, তাঁর যুক্তি ছিল এমন বোমা বানানো ইসলাম অনুসারে নিষিদ্ধ। ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে, পাকিস্তান ইরানকে বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মূল উপাদান সরবরাহ করেছিল।

১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে আব্দুল কাদির খান যখন মধ্যপ্রাচ্যে যেতেন, তখন তাঁর ওপর নজরদারি চালাতো মোসাদ। কিন্তু এই বিজ্ঞানী তখন কী করছেন তা জানতে ব্যর্থ হয় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাটি।

তৎকালীন মোসাদ প্রধান শ্যাভিট পরে বলেছিলেন যে তিনি যদি আব্দুল কাদিরের উদ্দেশ্য বুঝতে পারতেন, তবে তিনি আব্দুল কাদিরকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কথা বিবেচনা করতেন।

পাকিস্তানের কথা ফাঁস করে দেন গাদ্দাফি

লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০০৩ সালে আব্দুল কাদির খানের গোপনে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফাঁস করে দেন। গাদ্দাফি তখন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করছিলেন।

গাদ্দাফি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং এমআই সিক্সের কাছে এও প্রকাশ করে দেন যে আব্দুল কাদির খান তাঁর (গাদ্দাফি) সরকারের জন্যও পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করছিলেন। কিছু মুরগির খামারের আড়ালে সেটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।

সিআইএ তখন লিবিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠানো যন্ত্রপাতি জব্দ করে। সুয়েজ খাল দিয়ে সেগুলো লিবিয়ায় পাঠানো হচ্ছিল। ইসলামাবাদের একটি ড্রাই ক্লিনার থেকে আনা ব্যাগের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্লুপ্রিন্টও খুঁজে পান তদন্তকারীরা।

লিবিয়ার এ বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর মার্কিনিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘আপনি যখন এটি ভাবতে যাবেন আপনার কাছে তা অতি আশ্চর্যজনক মনে হবে। এমন কিছু যা আমরা আগে কখনো দেখিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত আব্দুল কাদির খান প্রয়োজনীয় উপাদানের ছোট ছোট বাজারকে কাজে লাগিয়ে বেশ উন্নত পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরি করেছিলেন। তারপর তিনি পুরো সরঞ্জাম এমনকি বোমার নকশা পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ কিছু সরকারের কাছে বিক্রি করার উপায় খুঁজে বের করেন।’

দ্বিতীয়বার পাকিস্তানকে বাঁচালেন তিনি

২০০৪ সালে আব্দুল কাদির খান পারমাণবিক বিস্তার নেটওয়ার্ক পরিচালনার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে তিনি ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেন। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে তিনি টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে দাবি করেন যে তিনি একা এ কাজ করেছেন এবং এ কাজে পাকিস্তান সরকারের কোনো সমর্থন ছিল না।

পাকিস্তান সরকারও তাঁকে এ ব্যাপারে দ্রুত ক্ষমা করে দেয়। প্রেসিডেন্ট মোশাররফ তাঁকে ‘আমার নায়ক’ বলে সম্বোধন করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তিনি আব্দুল কাদির খানকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখেন।

পরে আব্দুল কাদির খান বলেন যে, একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বানিয়ে পাকিস্তানকে তিনি প্রথমবার রক্ষা করেছিলেন এবং আবারও রক্ষা করেছিলেন যখন তিনি সব দায় নিজে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, সব দোষ নিজের ওপর নিয়েছিলেন।

২০০৬ সালে তাঁর প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়েছিল কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। যারা তাঁকে চিনতেন তাঁরা বলেন যে আব্দুল কাদির খান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তিনি যা করেছেন তা সঠিক ছিল।

তিনি পশ্চিমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং অ-পশ্চিমা, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোকে পারমাণবিক প্রযুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর পরিচিত একজন ব্যক্তি বলেন, ‘তিনি আরও বলেছিলেন যে একটি মুসলিম দেশকে প্রযুক্তি দেওয়া কোনো অপরাধ নয়।’

২০২১ সালে আব্দুল কাদির খান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে ‘জাতীয় আইকন’ বলে অভিহিত করে প্রশংসা করেছিলেন। এভাবেই তিনি আজও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

এই পরমাণুবিজ্ঞানী ২০১৯ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘জাতি নিশ্চিত থাকতে পারে যে পাকিস্তান এখন একটি নিরাপদ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, কেউ এর দিকে কুনজর দিতে পারবে না।’

মিডল ইস্ট আইম থেকে অনুবাদ