সম্প্রতি নেপালজুড়ে রাজতন্ত্রের পক্ষে অনেক বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। অনেক বিক্ষোভে ভারতের কট্টরপন্থী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পোস্টার বহন করা হয়। এটা কিন্তু আকস্মিক কিছু নয়। এসব পোস্টার নেপালে রাজতন্ত্রের স্মৃতি এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান হিন্দু জাতীয়তাবাদের মধ্যে আদর্শিক মিলকে নির্দেশ করে। ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর আদর্শিক পরামর্শদাতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর অনেকে মনে করেন যে সভ্যতার বিজয় এবং ভারতের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা – দুই কারণেই নেপালে রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি নেপালের ইতিহাস, এর রাজনৈতিক জটিলতা এবং ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থের উপর প্রভাবের একটি বিপজ্জনক ভুল ব্যাখ্যা।
ভারত মনে করছে, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা উপস্থিতির কারণে নেপালে একটি সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত, হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজতন্ত্রের ধারণা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এর সমর্থকরা যুক্তি দেন যে একজন হিন্দু রাজা বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রতিরক্ষা হিসাবে কাজ করতে পারেন। রাজার পক্ষে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি জোরদার এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থির দেশটিকে স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে। এই বয়ান ভারতীয় ডানপন্থী ভাষ্যকার এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
কিন্তু এই কল্পনা ঐতিহাসিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং এতে কৌশলগত দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে।
আসলে নেপালের রাজতন্ত্র কখনও ভারতের একনিষ্ঠ মিত্র ছিল না। ১৯৫০ সালে রাজা ত্রিভুবনের নির্বাসন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সমর্থনে প্রত্যাবর্তনের পর, নেপালে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র নিয়ে উচ্চাশা ছিল। কিন্তু দ্রুত তা নিরাশায় পরিণত হয়। ১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি ভারতপন্থী রাজনীতিবিদদের দমন করে নেপালকে চীনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসেন। ২০০৫-০৮ মেয়াদে তার পুত্র রাজা জ্ঞানেন্দ্রের শাসনামলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদারের পরিবর্তে নেপালের রাজারা প্রায়শই ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তারা অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা সুসংহত করতে এবং সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করেন। বিশেষ করে, জ্ঞানেন্দ্রের শাসনামলে নয়াদিল্লি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং দেশটি চীনের কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্থিতিশীল শক্তি হওয়ার পরিবর্তে নেপালের রাজতন্ত্র বারবার স্বৈরতন্ত্র এবং কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার উৎসে পরিণত হয়েছে।
নেপালে নতুন করে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান হিন্দু রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বানের সাথে মিলে যায়। আবার, নেপালের হিন্দু পরিচয়পন্থীদের সবাই রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষে নন। দেশটির অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দল নেপালি কংগ্রেস হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা সমর্থন করলেও রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে। এই পার্থক্য বুঝতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বোঝায়। আর, হিন্দু রাষ্ট্রের আহ্বান হলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখার দাবি।
উভয় আখ্যানই নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারনের মধ্যে ব্যাপক হতাশা থেকে উদ্ভূত। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে কোনও নির্বাচিত সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। অদক্ষতা এবং দুর্নীতির জন্য অনেক নেপালি ফেডারেলিজমকে দায়ি করেন। সেখানে এখন জনপ্রিয় কৌতুক হলো: “আগে আমাদের একজন রাজা ছিল, এখন রাজা ৭৬১ জন।”
এই মোহভঙ্গই রাজতন্ত্র ও ধর্মতান্ত্রিক কল্পনাবিলাশ তৈরি করেছে।
বিজেপি-আরএসএস নেপালের রাজতন্ত্রবাদীদের যে সমর্থন দিচ্ছে তার মূলে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদ এবং কেন্দ্রীভূত ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি আদর্শিক সখ্যতা। নেপালের রাজতন্ত্রপন্থীরা যোগী আদিত্যনাথের মতো ব্যক্তিত্বকে হিন্দু ধর্মবাদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মিশ্রণের প্রতীক হিসেবে দেখে। নেপালে বিক্ষোভকারীদের হাতে আদিত্যনাথের ছবি তারই প্রকাশ।
ভারতের অনেক পদক্ষেপ নেপালে দেশটির ভাবমূর্তি উন্নত করেনি। ১৯৮৯ ও ২০১৫ সালে দুই দফা অবরোধ নেপালে অর্থনৈতিক দুর্দশা সৃষ্টি করে এবং নেপালিদের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ তৈরি করে। নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। ২০২১ সালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পেছনে ভারতের হাত ছিল বলে নেপালে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়।
এরই মাঝে চীন নিজেকে “নিরপেক্ষ অংশীদার” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। নেপালের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এবং নেপালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বেইজিংয়ের পদচিহ্ন আরো প্রসারিত করেছে। অন্যদিকে, রাজতন্ত্রীদের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সখ্য নেপালের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
নেপালে অস্থিরতার পেছনে বেকারত্ব, গ্রামীণ দারিদ্র্য এবং অভিজাত শ্রেণীর শাসনের মতো যেসব কাঠামোগত কারণ রাজতন্ত্র রয়েছে সেগুলো নিরসন করতে পারবে না। বর্তমানে ৪০ লাখের বেশি নেপালি বিদেশে কাজ করে। জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ রেমিট্যান্স থেকে আসে। বিশেষ করে বাণিজ্য, বিদ্যুৎ এবং ট্রানজিট অবকাঠামোর জন্য নেপালের অর্থনীতি এখনও ভারতের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ।
আাসলে রাজতন্ত্রের উপর বাজি ধরা ভারতের কোনও বৈদেশিক নীতি কৌশল নয় – এটি একটি কল্পনা। ভারত যদি চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করতে এবং নেপালে প্রভাব বজায় রাখতে চায় তাহলে তাকে বহুত্ববাদ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক একীকরণে বিনিয়োগ করতে হবে। কাঠমান্ডুতে যোগী আদিত্যনাথের চিত্র নাগপুরের কিছু লোককে উত্তেজিত করতে পারে কিন্তু এটা নেপালের অনেককে এবং ভারতের কূটনৈতিক মহলকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব সবসময় তার গণতান্ত্রিক মডেল থেকে এসেছে, সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে নয়।
দেবতাদের স্মৃতিচারণ দিয়ে সেই মডেলকে প্রতিস্থাপন করা হলে তা কেবল প্রতিপক্ষকেই সুবিধা দেবে, যারা অংশীদারিত্ব সৃষ্টির জন্য অভ্যন্তরিণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না।
ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ