দক্ষিণ এশিয়ায় ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাব হবে গুরুতর

দক্ষিণ এশিয়ায় ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাব হবে গুরুতর
তেল আবিবের কাছে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত একটি বহুতল ভবন। ছবি: আল জাজিরা

শুক্রবার (১৩ জুন) ইরানে ইসরায়েলের হামলা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটা আরও বিস্তৃত সংঘাতে পরিণত হতে পারে এবং এতে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় এবং অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলো জড়িয়ে পড়তে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের যেকোন অস্থিতিশীলতায় অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাম্প্রতিক সংঘাত শুধু এই অঞ্চলকেই নয় গোটা বিশ্বের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর প্রেসিডেন্ট ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান বাংলাদেশের একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি যা ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সংঘাত বর্তমান পরিধির বাইরে ছড়িয়ে পড়ার গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

আমরা ইতিমধ্যেই সংঘাতের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি উল্লেখ করে এএনএম মুনিরুজ্জামান বলেন, এর প্রথম আঘাতটি এসেছে বিমান চলাচলের উপর। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল এড়াতে বিমান সংস্থাগুলো ফ্লাইটের রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে ভ্রমণের সময় বেড়ে যাচ্ছে, জ্বালানি খরচ বাড়ছে এবং টিকিটের দামও বেড়ে যাবে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে আমাদের বিদেশ যাত্রা ও পণ্য আমদানি-রফতানি ব্যাহত হতে পারে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইতিমধ্যে চাপে থাকা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে নতুন করে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে অতিক্রম করা গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এবং স্থল বাণিজ্য রুটগুলো অনিরাপদ বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘ ও ঘুরপথে পণ্য পরিবহনের ফলে বিলম্ব, খরচ বেড়ে যাওয়া এবং লজিস্টিক সুবিধা না পাওয়ার মতো বাধার সৃষ্টি হবে। এতে অনিবার্যভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়কেই প্রভাবিত করবে।

এএনএম মুনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি জ্বালানি বাজারের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাস সরবরাহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই অঞ্চলে যেকোনো অস্থিরতা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারকে ধাক্কা দেয়। আমরা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জ্বালানি মূল্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করেছি এবং এই প্রবণতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এবং সম্ভবত আরও খারাপ হতে পারে। এটা নির্ভর করবে, সংঘাত কীভাবে ছড়িয়ে পড়বে, তার উপর। মূল্যের ওঠানামা কেবল জ্বালানির দামকেই প্রভাবিত করবে না বরং পরিবহন, উৎপাদন এবং গৃহস্থালীর জ্বালানি ব্যয়ের উপরও প্রভাব ফেলবে।

তার মতে, উদ্বেগের আরেকটি ক্ষেত্র হল শ্রমবাজার। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনেক দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ওই অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করবে। ফলে শ্রম চাহিদা হ্রাস, মজুরি হ্রাস, এমনকি কর্মসংস্থাও হারাতে হতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়বে হাজার হাজার পরিবারের আয় এবং আমাদের মতো শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলোর সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের উপর ।

ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক এএনএম মুনিরুজ্জামান মনে করেন এই সংঘাত আরো অনেক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করতে পারে – যোগাযোগ, বাণিজ্য, জ্বালানি, শ্রম এবং জাতীয় নিরাপত্তা। অস্থিতিশীলতা যত বেশি সময় ধরে চলবে, এই প্রভাবগুলো তত স্পষ্ট হবে।

এদিকে, ভারতের একটি সংবাদ মাধ্যমকে নয়াদিল্লি-ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনসাইটস প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা ড. শুভদা চৌধুরী বলেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে এই সংঘাত ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আরও তীব্র করতে পারে। ইসরায়েলের সাথে ভারতের সম্পর্ক প্রতিরক্ষার, তারা ভারতের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। অন্যদিকে, প্রতিবেশী ইরানের প্রতি পাকিস্তানের ঐতিহাসিক সহানুভূতি রয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে, দক্ষিণ এশিয়া উপসাগরীয় তেল ও গ্যাসের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ভারতের একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী ইরান। এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়ে যেতে পারে। ভারত, তার ৮০% তেল আমদানি করে। এতে দেশটি মুদ্রাস্ফীতির চাপে পড়বে। ফলে তার অর্থনীতিতে চাপ পড়বে।

ইসরায়েলের হামলার পর, ভারতের শেয়ার বাজার প্রায় ৮০০ পয়েন্ট কমে যায়। একই সময়ে, বিশ্বব্যাপী তেলের দাম প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। শুক্রবার ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল ব্যারেল প্রতি ৭৮ ডলারে লেনদেন হয়।

হরমুজ প্রণালী অবরোধ বা ইরানের উপর নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতের জন্য অর্থনৈতিক ধাক্কা, কৌশলগত বিপর্যয় এবং নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন ড. চৌধুরী।

তিনি বলেন, কূটনৈতিকভাবে, ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার বিষয়ে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান পরীক্ষার সম্মুখিন হবে। ইরানে চাবাহার বন্দরে ভারত বিনিয়োগ করেছে। তাই এখন ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কে তারা কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখে সেটা দেখতে হবে।

ইরানের চাবাহার বন্দর উন্নয়নের জন্য গত বছর (মে, ২০২৪) ভারত ৩৭০ মিলিয়ন ডলারের ১০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে। এর লক্ষ্য পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন। ইরানের উপর নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এই বিনিয়োগকে ঝুঁকিতে ফেলবে। হরমুজ প্রণালী অবরোধ চাবাহারের কার্যক্রম ব্যাহত করবে। এতে তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত (টাপি) পাইপলাইন প্রকল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে, এই সংঘাতের কারণে পাকিস্তানের জ্বালানি ঘাটতি আরও তীব্র হতে পারে, যা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আরও গভীর করে তুলতে পারে।

ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ড. চৌধুরী মনে করেন, ইরানে ইসরায়েলি হামলা পাকিস্তানকে ইরানের আরও কাছে ঠেলে দিতে পারে। এতে আফগানিস্তানে তেহরানের প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। ফলে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ পরিকল্পনা জটিল হবে।

অন্যদিকে, এএনএম মুনিরুজ্জামান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি একটি গভীর উদ্বেগজনক ঘটনা।

তিনি বলেন, পরিস্থিতির আরও অবনতি রোধ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে।