ড্রোন তৈরি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

ড্রোন তৈরি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
প্রতীকী ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

স্থল-ভিত্তিক যুদ্ধ ক্ষমতা আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে দেশীয়ভাবে ছোট আকারের ড্রোনের উন্নয়ন ও তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যা এই বাহিনীর ডকট্রিনাল (মতবাদগত) পরিবর্তনের ইংগিত দিচ্ছে। এই উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্যে পিছিয়ে থাকার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়েছে।

প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট বিডিমিলিটারি এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী স্বল্প ব্যয়ে একটি নির্ভরযোগ্য ও আঞ্চলিক হুমকি পরিবেশের উপযোগী ড্রোন তৈরি করার ব্যাপারে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। একই সঙ্গে দুটি ভূমিকা পালনের জন্য ড্রোনগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। এগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং শত্রু এলাকায় রেকি (আইএসআর) করার পাশাপাশি শত্রুসেনা ও শত্রুর হালকা যানবাহনের উপর ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড ও লো-ইল্ড মর্টার হামলা চালাতে পারবে।

বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক সংঘাতগুলোতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি গুনিতক হারে বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন আকারের ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করে অতি অল্প খরচে শত্রুর মূল্যবান প্রচলিত অস্ত্র ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেয়া যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রভাব স্পষ্ট। সেখানে গতানুগতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ১০,০০০ মার্কিন ডলারেরও কম দামের ছোট এফপিভি (ফার্স্ট পারসন ভিউ) ড্রোন দিয়ে সফলভাবে শত্রুর মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক (এমবিটি) এবং ফিল্ড কমান্ড পোস্ট ধ্বংস করা হচ্ছে।

সিরিয়া, ইরাক ও নাগোর্নো কারাবাখে তুরস্কের এসটিএম কোম্পানির তৈরি ‘লয়টারিং মিউনিশন্স এন্ড রিকনেসান্স ড্রোন’ প্রমাণ করেছে যে কৌশলগত স্তরে হালকা ড্রোন ব্যবহার করা গেলে তা পদাতিক ইউনিটগুলোর অভিযানের গতি এবং টিকে থাকার ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করতে পারে।

মিয়ানমার সীমান্ত এবং ভারতের সাথে উত্তর ফ্রন্টে সক্রিয়, হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অনিয়মিত বাহিনীগুলো বাংলাদেশের প্রাথমিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। এদের মোকাবেলায় ছোট আকারের কৌশলগত ড্রোনগুলো খুবই কার্যকর হবে। এই সিস্টেমগুলো আইএসআর সরবরাহ করবে, প্লাটুন বা কোম্পানি পর্যায়ের কমান্ডারদের কাছে স্থানিক ও শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য ও ছবি পাঠাবে। তাছাড়া স্বল্প খরচে নির্ভুল হামলা চালাতে সক্ষম হওয়ায় এসব ড্রোন গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা না নিয়ে বা সম্মুখ যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি ছাড়াই শত্রুর উপর অতর্কিত হামলা, ফরোয়ার্ড পোস্ট বা মর্টার বাহিনীকে দ্রুত ধ্বংস করতে পারবে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো প্রতিপক্ষ প্রচলিত রণকৌশলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এই বাহিনীর ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রতিরক্ষা ও ড্রোন প্রতিরোধ ক্ষমতা – কোনটাই নেই। একইভাবে, সীমান্তে মোতায়েন করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী ইউনিটগুলো প্রায়শই সক্রিয় ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করে। প্রতিপক্ষের ড্রোন হামলার মুখে তারা অসহায়। এই ধরনের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কৌশলগত ড্রোনগুলো কেবল একটি কৌশলগত সুবিধাই দেবে না বরং প্রতিরোধমূলক সুবিধাও দিবে।

সারা বিশ্বে সমপর্যায়ের অনেক সামরিক বাহিনী তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার ড্রোন দিয়ে সমৃদ্ধ করছে। পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার কোর এবং নিয়মিত পদাতিক ইউনিটগুলো অস্থির পশ্চিমাঞ্চলে জন্য আইএসআর ড্রোন ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, ভারত কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজগুলোতে বিদ্রোহ-দমন অভিযানে সীমিত সংখ্যক কোয়াডকপ্টার মোতায়েন শুরু করেছে। তবে, দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে ড্রোন সংযুক্ত করার কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। ফলে বাংলাদেশ সবার আগে  ডিজিটালি নেটওয়ার্কযুক্ত, নির্ভুল হামলায় সক্ষম যুদ্ধকৌশল গ্রহণের দিকে অগ্রসর হতে পারে।

দাম ও রক্ষণাবেক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ড্রোনগুলো অপারেশনাল মূল্য হবে বিশাল। যেখানে প্রচলিত আর্টিলারি বা বিমান সহায়তার জন্য ব্যাপক অবকাঠামো, সেনা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়, সেখানে মাত্র দুই-সদস্যের সেনাদলকে দিয়েই মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি কৌশলগত ড্রোন মোতায়েন করা যায়। যুদ্ধাস্ত্র, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ একটি আইএসআর-স্ট্রাইক ড্রোনের দাম সাধারণত ১০,০০০ ডলারের কম। আর যদি পুরো জীবনচক্রের খরচ বিবেচনা করা হয় তাহলে অবশ্যই একটি কামানের গোলা রক্ষণাবেক্ষণের খরচও এর চেয়ে বেশি। সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে যেখানে সেনাদলের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো এবং সম্পদ সংরক্ষণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে এই ধরনের একটি বা দুটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষতি হলেও কমান্ডাররা অভিযানের চাপ সহজেই সামলে নিতে পারেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপ বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবণতার প্রতিফলন। কৌশলগত ড্রোন অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল একটি নতুন অস্ত্রই হাতে পাচ্ছে না বরং এতে তার সামরিক সংস্কৃতিও আধুনিক যুদ্ধের চাহিদা অনুযায়ী পুননির্মিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ও ক্রমবর্ধমান হুমকির পরিবেশে, কৌশলগত ড্রোন তৈরিতে  নিম্ন-মধ্য আয়ের বাংলাদেশের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যৌক্তিক ও দূরদর্শী ভাবনার ইংগিত দেয়।