জে-১০সি ফাইটার কিনছে বাংলাদেশ: বদলে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিমান শক্তির ভারসাম্য

জে-১০সি ফাইটার কিনছে বাংলাদেশ: বদলে যাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিমান শক্তির ভারসাম্য
জে-১০সি, ছবি: সংগৃহীত

চীনের তৈরি জে-১০সি মাল্টিরোল ফাইটার কেনার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যাধুনিক এই জঙ্গি বিমানের দ্বিতীয় অপারেটর হতে যাচ্ছে দেশটি। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে সামরিক শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক পাক-ভারত আকাশযুদ্ধে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে চেংদু এয়ারক্রাফট কর্পোরেশনের (সিএসি) তৈরি জে-১০সি। ফলে পশ্চিমা সমরবিদরা মাঝারি ওজনের এই সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটারের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পাকিস্তানের দাবি জে-১০সি ব্যবহার করে ভারতের ফরাসী কোম্পানি ডসাল্টের তৈরি ৩টি অত্যাধুনিক রাফালে ফাইটার ভূপাতিত করা হয়েছে। ভারত এই দাবি স্বীকার না করলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সূত্রগুলো পাকিস্তানের দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। ফলে জে-১০সি এখন চীনা বিমানশক্তির আইকন।

মালয়েশিয়াভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া’ জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ) ১৬টি জে-১০সি কেনার চেষ্টা করছে। এগুলো দিয়ে দেশের পুরনো জঙ্গি বিমান বহর বদলে ফেলা হবে।

ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে বিমান শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের তীব্র প্রতিযোগীতার কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশে যে পরিবর্তন ঘটছে তার গুরুত্ব অনুধাবন করেই ঢাকা তার বিমান শক্তি আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা শুরু করেছে।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান জে-১০সি’র প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আক্রমণাত্মক হেলিকপ্টার অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।” যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য একই সঙ্গে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তিনি।

১৬টি জে-১০এফ সংগ্রহ হবে বিএএফ’কে পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ কৌশলের সূচনা মাত্র।

গত বছরের আগস্টে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চীন বাংলাদেশের পুরনো এফ-৭ পরিবর্তনের জন্য জে-১০সি ফাইটার সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীন দীর্ঘদিনের মিত্র।

পাকিস্তানের একটি জে-১০সি, ছবি: সংগৃহীত

ভারত রাফালে কেনার পর শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ২০২২ সালে পাকিস্তান ২৫টি জে-১০সি কেনে। পাকিস্তানের এই ক্রয় দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ যুদ্ধে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে তুলে ধরে।

দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে জে-১০সি কেনার আলোচনায় শেষ পর্যায়ে আছে মিশর। তারা চীনা ফাইটারকে যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো এফ-১৬ এর সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে দেখছে। আমেরিকার রপ্তানি নীতির সীমাবদ্ধতার কারণে এফ-১৬ রক্ষণাবেক্ষণ করা মিশরের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

চীন ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রথম জে-১০সি জনসম্মুখে হাজির করে। পরের বছর এটি  পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স (পিএলএএএফ)-এর অপারেশনাল সার্ভিসে যুক্ত হয়। আর এখন, বিশ্বের যেসব দেশ পশ্চিমা রাজনৈতিক বিধিনিষেধ এড়িয়ে তুলনামূলক সস্তায় চতুর্থ প্রজন্মের চেয়েও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তালাশ করছে তাদের কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে জে-১০সি।

গত বছর ঝুহাইতে অনুষ্ঠিত এয়ারশো চায়না ২০২৪-তে আজারবাইজান বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা জে-১০সি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন। এতে বুঝ যায় এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও এই যুদ্ধবিমানের প্রতি আগ্রহ রয়েছে।

আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পিএলএএএফ-এর হাতে বর্তমানে ১৫০ টিরও বেশি জে-১০সি ফাইটার রয়েছে। একে চীনের কৌশলগত যুদ্ধবিমান বহরের মেরুদণ্ড বলা চলে। এটি বেইজিংয়ের বিমান শক্তি মতবাদের মূল উপাদানও বটে।

জে-১০সি এয়ারফ্রেম আগের সংস্করণগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। এর রয়েছে উন্নত স্টিলথ বৈশিষ্ট্য এবং এতে চীনের নিজস্ব তৈরি ডব্লিউএস-১০সি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এই ইঞ্জিনের থ্রাস্ট-টু-ওয়েট অনুপাত বেশি, ইনফ্রারেড সিগনেচার (অর্থাৎ ইনফ্রারেড সেন্সরে এর উপস্থিতি ধরা পড়ার সম্ভাবনা) সর্বনিম্ন এবং রাশিয়ান প্রপালশন সিস্টেম থেকেও এটি আলাদা।

এতে এ্যাকটিভ ইলেক্ট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে (এইএসএ) রাডার যুক্ত করার ফলে এর ফাইটিং ক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। এই রাডার দ্রুত ও নির্ভুলভাবে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান দিতে পারে। পারে একই সঙ্গে অনেকগুলো টার্গেট ট্র্যাকিং করতে। এগুলো বৈশিষ্ট্য ফাইটারটিকে দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সাহায্য করে।

জে-১০সি-কে প্রায়শই আমেরিকান এফ-১৬ এর সাথে তুলনা করা হলেও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন যে এতে আসলে ইসরায়েলের বাতিল হওয়া লাভি ফাইটার প্রকল্পের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

জে-১০সি-এর সবচেয়ে চমৎকার বৈশিষ্ট্যগুলির একটি হল রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি অত্যাধুনিক রাডার-গাইডেড পিএল-১৫ বিভিআর এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল। এটি ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোন টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এআইএম-১২০ আমরাম ক্ষেপনাস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে পিএল-১৫। বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই চীনা ক্ষেপনাস্ত্রটিকে একটি গেম-চেঞ্জিং এসেট হিসেবে বিবেচনা করেন। এই অস্ত্র সজ্জিত ফাইটার আকাশযুদ্ধের ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।

রাশিয়ান স্যাটার্ন এএল-৩১এফ ইঞ্জিনের পরিবর্তে জে-১০সি ফাইটারে নিজস্ব তৈরি ডব্লিউএস-১০সি  ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এটা চীনকে কেবল প্রযুক্তিগত স্বাধীনতাই দেয়নি বরং রপ্তানি-সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিধিনিষেধের জাল থেকেও মুক্তি দিয়েছে। ফলে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো সংবেদনশীল বাজারে জে-১০সি রফতানি করতে তাকে কারো সম্মতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

বাংলাদেশ এই হাই-প্রোফাইল ফাইটার কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় বিমান শক্তির ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। এতে আকাশে আধিপত্য বিস্তার এবং ভারত বা মিয়ানমারের মতো আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের যেকোনো হামলা বা উস্কানির উপযুক্ত জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার সক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাবে।

জে-১০সি এর মতো ৪.৫++ প্রজন্মের মাল্টিরোল প্ল্যাটফর্ম যুক্ত হলে বাংলাদেশের প্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশটি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য বিমান শক্তি প্রদর্শন এবং নিজের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে সক্ষম হবে।

ডুয়েল-রোল ফাংশনালিটি’র জে-১০সি ফাইটার আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্থলভাগে নির্ভুল আক্রমণ চালাতে সক্ষম। এতে বাংলাদেশ বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে (ইইজেড) আরও দৃঢ়তার সঙ্গে অ্যান্টি-অ্যাক্সেস/এরিয়া ডিনায়াল (এ২/এডি) কৌশল বাস্তবায়নে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনা সামরিক হার্ডওয়্যারের গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট। বাংলাদেশের অস্ত্র ভাণ্ডারে রয়েছে চীনের তৈরি এমবিটি-২০০০ মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক, জেএফ-১৭ থান্ডার লাইট ফাইটার, সি-৮০২এ জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্বল্প-পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এফ-৯০। এগুলো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিভিত্তি তৈরি করেছে।

জে-১০সি সংগ্রহ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও গভীর করবে। এতে আকাশ, স্থল এবং সামুদ্র ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারঅপারেবিলিটি নিশ্চিত হবে। এতে কেবল পরিচালনা খরচ এবং সিস্টেমের বাহুল্য কমে আসবে না বরং বাংলাদেশকে সামরিক আগ্রাসনের  বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে উপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম করে তুলবে। যা বর্তমানের অস্থির কৌশলগত পরিবেশে জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।