থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় দিনের মতো পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির আহ্বানের পরও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন এলাকায়। দুই পক্ষের তীব্র গোলাবর্ষণে বেড়েছে নিহতের সংখ্যাও। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংঘাতে থাইল্যান্ডের অন্তত ১৫ জন এবং কম্বোডিয়ায় একজনের প্রাণহানি হয়েছে। রয়টার্স
সীমান্ত নিয়ে বিরোধের জেরে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। আজ শুক্রবার ছিল সংঘাতের দ্বিতীয় দিন। এদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই কম্বোডিয়া হামলা শুরু করে বলে জানিয়েছে থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী। তাদের ভাষ্যমতে, হামলা ৬ এলাকা থেকে ১২ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। হামলা হচ্ছে স্কুল ও হাসপাতালেও।
এসব হামলায় কম্বোডিয়া কামানের গোলা ও রাশিয়ার তৈরি বিএম-২১ রকেট উৎক্ষেপণব্যবস্থা ব্যবহার করছে বলে দাবি করেছে ব্যাংকক। হামলার দায় কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সরকারের ওপর চাপিয়েছে থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, বেসামরিক লোকজনকে নির্বিচার লক্ষ্যবস্তু করাটা যুদ্ধাপরাধ। দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
কম্বোডিয়ার হামলায় আজ পর্যন্ত থাইল্যান্ডে ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। থাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিহত ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জনই বেসামরিক লোকজন। এ ছাড়া ১৫ সেনাসদস্যসহ আহত হয়েছেন ৪৬ জন। সংঘাতের মধ্যে থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
থাইল্যান্ডের হামলায় কত জন হতাহত হয়েছেন বা কতজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, সে তথ্য জানায়নি কম্বোডিয়া সরকার। আজ রয়টার্সের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে জানতে চাওয়া হলে জবাবও দেয়নি তারা। তবে দেশটির ওদ্দার মেয়ানচে প্রদেশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংঘাতে দেশটিতে ১ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছেন। ১ হাজার ৫০০ পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সীমান্ত নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিরোধ শত বছরের বেশি পুরোনো। ১৯০৭ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার দুই দেশের মধ্যে একটি সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। ওই মানচিত্র নিয়ে আপত্তি ছিল থাইল্যান্ডের। ২০০৮ সালে সীমান্তে বিরোধপূর্ণ এলাকায় ১১ শতকের একটি মন্দির নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। পরে বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত সংঘাতে দুই দেশেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয় গত মে মাসে। সে সময় সংঘর্ষে এক কম্বোডীয় সেনা নিহত হন। এর পর থেকে দুই দেশই সীমান্তে সেনা বাড়াতে থাকে। এরই মধ্যে সম্প্রতি সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হন থাইল্যান্ডের এক সেনা। ওই ঘটনার জেরে গত বুধবার কম্বোডিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেয় থাইল্যান্ড। কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকেও ব্যাংকক থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দুই পক্ষের মধ্যে প্রথমে ছোট আকারে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। দ্রুতই তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। বৃহস্পতিবার পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ ছাড়াও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিয়ে কম্বোডিয়ায় হামলা চালায় থাইল্যান্ড। সংঘাত ঘিরে দেশটি মোট ছয়টি এফ-১৬ মোতায়েন করেছে। আজ পর্যন্ত ২১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুই পক্ষের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত চলছিল।
থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশ থেকে রয়টার্সের সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সেখানে তাঁরা কয়েক ডজন ট্রাক, সাঁজোয়া যান, ট্যাংকসহ থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর একটি বহর দেখেছেন। সেগুলো সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল বিস্ফোরণের শব্দ। সুরিন প্রদেশে গ্রামের একটি সড়কের ওপর থেকে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করতেও দেখেছেন তাঁরা।
প্রদেশটিতে বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে অনেক বেসামরিক লোকজন আজও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন। তাঁদের একজন ৬৭ বছর বয়সী অং ইং। অশ্রুসিক্ত চোখে রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমরা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এখানে পালিয়ে এসেছি। খুব ভয়ের মধ্যে আছি। এই সংঘাতের কারণে অনেক মানুষ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এভাবে থাকতে খুবই খারাপ লাগে।’
নতুন করে সংঘাত শুরুর জন্য একে অপরের ওপর দোষারোপ করে আসছে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। থাইল্যান্ডের অভিযোগ, দেশটির বেসামরিক লোকজনের ওপর নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে কম্বোডিয়া। আর কম্বোডিয়ার দাবি, দেশটিতে হামলা চালাতে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) বোমা ব্যবহার করছে থাইল্যান্ড। সংঘাতে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
শুক্রবার থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচাইয়াচাই বলেছেন, থাইল্যান্ডের একাধিক এলাকায় হামলা চালিয়েছে কম্বোডিয়া। বর্তমানে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তাতে অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসনের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। একই আহ্বান থাইল্যান্ডে দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রেরও।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমুখপাত্র টমি পিগট বৃহস্পতিবার নিয়মিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধ, বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা ও সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’ এই সংঘাত নিয়ে গতকাল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকের কথাও ছিল।
সংঘাত থামাতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সংলাপ আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মালয়েশিয়া। তবে ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা মানবে না দেশটি। আজ থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিকর্নদেজ বালানকুরা বলেন, ‘আমাদের অবস্থান হলো, সংঘাত থামানোর জন্য দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টাই হলো সবচেয়ে ভালো পথ।’