দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি ‘ত্রিপক্ষীয় জোট’?

দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি ‘ত্রিপক্ষীয় জোট’?
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে (২১ আগস্ট) পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপে যোগ দেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এবং পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার। ছবি: সিনহুয়া

বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় বেইজিং সম্ভবত আরেকটি ত্রিদেশীয় ‘পাকিস্তান-চীন-আফগানিস্তান’ জোট গঠনের প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। ষষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপে যোগ দিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ২১ আগস্ট কাবুল সফর করেন। এই সংলাপের পাশাপাশি একটি ত্রিপক্ষীয় জোট গঠন নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হওয়ার কথা। ওয়াং ই পরে ইসলামাবাদ সফর করেন। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ফলাফল সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে এটা ২১শে মে বেইজিংয়ে সংশ্লিষ্ট তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের ধারাবাহিকতা বলে ধারণা করা যায়।

চলতি মাসের শুরুতে (৫ আগস্ট) মুত্তাকির পাকিস্তান সফরের কথা ছিল। কিন্তু কারিগরি কারণ দেখিয়ে সফরটি বাতিল করা হয়। সূত্র মতে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মুত্তাকির ভ্রমণে বাধা দেয় কারণ তিনি এখনও জাতিসংঘের “নিষিদ্ধ” তালিকায় রয়েছেন। তাই কাবুলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটির আয়োজন করা হয়।

বেইজিং বৈঠকের বিষয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল যে এতে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পারস্পরের জন্য লাভজনক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন।

বৈঠক শেষে এক ঘোষণায় বলা হয়, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান উভয়ই কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে স্পষ্ট ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং লেনদেন ও কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করার জন্য যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের বিষয়ে তারা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এই আগ্রহ তালেবানের সাথে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করেছে।

এই পদক্ষেপ আংশিকভাবে ভারতের সাথে তালেবানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে, দার স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তালেবানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি বেইজিংয়ের অনুরোধে করা হয়েছে।

পাকিস্তান এবং তালেবান শাসনের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক কেবল পাক-আফগান সম্পর্কই নয় বরং তিন দেশের মধ্যে সামগ্রিক সহযোগিতাও জোরদার করবে। কাবুলের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) মাধ্যমে আফগানিস্তানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

সন্ত্রাসবাদ দমন তিনটি দেশের জন্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। মে’র বৈঠকে দেশগুলো সকল ধরণের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা, আইন প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা সহযোগিতা পরিচালনা এবং উভয় পক্ষের উদ্বেগের সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করতে এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে সম্মত হয়।

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। তালেবান শাসন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি ‘ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ’ (আইএসকেপি) আফগানিস্তানে এখনো সক্রিয়। তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর মতো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত আল-কায়েদা এবং এর সহযোগী গোষ্ঠীগুলো তালেবানের সমর্থন পাচ্ছে।

সন্ত্রাসবাদ দমন নিয়ে চীনের উদ্বেগ কম নয়। তাদের আশঙ্কা উইঘুর স্বাধীনতাকামীরা চীনের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানোর জন্য আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে। তাই চীন চায় আফগানিস্তান যেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তবে, তালেবান ও উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে তালেবান সরকার তা করতে অনিচ্ছুক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের লড়াইয়ে চীনেরও ভূমিকা রয়েছে। কারণ, টিটিপি এবং বেলুচ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো প্রকাশ্যে চীনা বিনিয়োগ এবং সিপিইসি প্রকল্পগুলোতে জড়িত চীনা নাগরিকদের উপর হামলা করছে।

সন্ত্রাসবাদ দমনের পাশাপাশি, বিআরআই-তে আফগানিস্তানের সম্পৃক্ততা আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীন দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানকে বিআরআই-তে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে আসছে। এই উদ্যোগের অধীনে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য চীন ২০১৬ সালে পূর্ববর্তী আফগান সরকারের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছিল, কিন্তু এই বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদে চীনের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বেইজিংয়ের জন্য বিআরআই-এর সম্প্রসারণ অপরিহার্য এবং আফগানিস্তানকে সিপিইসির সাথে সংযুক্ত করাই হবে সর্বোত্তম পথ।

সিপিইসি-তে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তি তালেবান শাসনের জন্যও লাভজনক। তালেবানের অর্থ-উপমন্ত্রী আব্দুল লতিফ নাজারির মতে, সিপিইসি-তে আফগানিস্তানের অংশগ্রহণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব হ্রাস, অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মে মাসের বৈঠক শেষে তিন দেশ ঘোষণা করে যে তারা আফগানিস্তানকে সিপিইসির সাথে সংযুক্ত করতে রাজি হয়েছে।

তালেবান শাসনব্যবস্থা এখনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি এবং তুলনামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই সিপিইসি-তে অন্তর্ভুক্তি দেশটির বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। এই উন্নয়ন আফগানিস্তানের উপর তালেবানদের কার্যত শাসনব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

তবে, চীন কখন আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানকে বিআরআই-তে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং কোন শর্তে পাকিস্তান এই ব্যবস্থায় সম্মত হবে তা এখনও অনিশ্চিত। যেহেতু বেইজিং তালেবানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে ইসলামাবাদকে রাজি করাতে সফল হয়েছে, তাই আফগানিস্তানকে সিপিইসি-তে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে হয়তো পাকিস্তানের খুব বেশি আপত্তি থাকবে না।

কাবুলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি সংশ্লিষ্ট তিন পক্ষের জন্য, বিশেষ করে তালেবান শাসনব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে তালেবানরা চলমান আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও, বিশেষ করে ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল দখলের বার্ষিকীর মাত্র কয়েকদিনের মাথায় বহুপাক্ষিক আলোচনা আয়োজন করতে পারছে। আন্তর্জাতিক চাপ, আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ জব্দের পরিপ্রেক্ষিতে, কাবুলে এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠক তালেবানদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক উৎসাহ বিশেষ। এই বৈঠকের ফলে যদি মে মাসে সম্পাদিত মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে আফগানিস্তানে সিপিইসি’র-এর আনুষ্ঠানিক সম্প্রসারণ ঘটে, তাহলে সেটা হবে তালেবানের কার্যত শাসনব্যবস্থার জন্য আরেকটি বিজয়।

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ